ভাগ্য যেখানে নিয়ে যায়

বেরিং স্ট্রেইট (Bering Straits) পার হয়ে এক দল এশিয়ান এসেছিল কানাডায়। কানাডায় প্রবেশের পর বরফে ঢেকে যায় সেই পথ। আর ফিরে যেতে পারেনি বেরিং স্ট্রেইট দিয়ে আসা এশিয়ানরা। পরবর্তীকালে উত্তর আমেরিকায় ছড়িয়ে পড়ে তারা। সাইবেরিয়া থেকে আসা উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকায় ছড়িয়ে পড়া সেই জনগোষ্ঠীকে বলা হয় উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকার আদিবাসী। উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকায় ছড়িয়ে পড়া আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সঙ্গে আর্কিওলজি, প্লাস্টিসিন জিওলজি, ফিজিক্যাল অ্যানথ্রোপলজি এবং ডিএনএ (archaeology, Pleistoncene geology, physical anthropology and DNA) প্রমাণ করে, সাইবেরিয়া থেকে আসা এশিয়ানদের সম্পর্ক সেই সময় থেকে। উত্তর আমেরিকায় এশিয়ানদের আগমনের ইতিহাস সুদীর্ঘ সময়ের হলেও বাংলাদেশিদের উত্তর আমেরিকায় বসতের ইতিহাস খুব দীর্ঘ নয়।

যখন একটি দেশের স্বাধীনতার ইতিহাস মাত্র ৫০ বছরের কম, তাহলে সেই দেশের জনগোষ্ঠীর অভিবাসন বা ইমিগ্রেশনের ইতিহাসও স্বাভাবিকভাবে দেশটির জন্ম ইতিহাসের সমসাময়িক হবে।

আমেরিকা অথবা কানাডায় অভিবাসী বা ইমিগ্র্যান্ট বাংলাদেশিদের ইমিগ্রেশনের ইতিহাস মাত্র ৫০ বছরেরও নয়। শুধু উত্তর আমেরিকার বাংলাদেশিদের ইমিগ্রেশনের ইতিহাস নয়, সারাবিশ্বে বাংলাদেশিদের ইমিগ্রেশনের ইতিহাস বাংলাদেশের স্বাধীনতার সমসাময়িক। যখন বাংলাদেশিরা সর্বপ্রথম কানাডা গমন করে তখন কানাডা যেতে বাংলাদেশিদের কোনো ভিসার প্রয়োজন হতো না। এয়ারপোর্টে নামার পর ভিজিট ভিসার একখানা সিল দিয়ে দিত। প্লেনের একখানা টিকিট কাটার সামর্থ্য যার ছিল, চাইলেই তেমন একজন সচ্ছল বাংলাদেশি কানাডা যেতে পারতেন। কিন্তু তখন সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত বাংলাদেশের মানুষের দেশত্যাগের ইচ্ছা জাগেনি। স্বাধীনতা অর্জনের পর বাংলাদেশের নাগরিকরা অর্জন করে তাদের চিরউন্নত অহংকার সবুজ পতাকা; সঙ্গে গাঢ় সবুজ পাসপোর্ট।

পাকিস্তান সরকারের দীর্ঘ দিনের শোষণ-বৈষম্যের অবসানের পর সবুজ পাসপোর্ট হাতে পেয়ে এক দল তরুণ বাংলাদেশি পাখির মতো ডানা মেলে দিল পৃথিবীর বুকে। ধীরে ধীরে ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা, দক্ষিণ আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্য, এশিয়া, আফ্রিকা অর্থাৎ বিশ্বের প্রায় সব দেশে গড়ে উঠল বাংলাদেশিদের বসত। সেই যে অভিবাসন বা ইমিগ্রেশনের শুরু; আজও থামেনি বাংলাদেশিদের সেই অভিবাসন বা ইমিগ্রেশন। বরং ক্রমশ বেড়েই চলেছে এই অভিবাসন বা ইমিগ্রেশনের সংখ্যা বা গল্পকাহিনি।

বাংলাদেশ রাষ্ট্রের নাগরিক আইন এই ইমিগ্রেশনের সপক্ষে বা সমর্থনে। একজন বাংলাদেশি নাগরিক বিশ্বের অপর কোনো রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব গ্রহণ করলে তাকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব ত্যাগ বা বিসর্জন দিতে হয় না বা সে বাংলাদেশের নাগরিকত্বের অধিকার হারায় না। সে বৈধভাবে বাংলাদেশসহ অন্য দেশের অর্থাৎ দ্বৈত নাগরিকত্ব রাখতে পারে। এটি স্বল্প আয়তনের অধিক জনসংখ্যা অধ্যুষিত মধ্যম আয়ের একটি দেশের জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ। এর ফলে বাংলাদেশের নাগারিকরা ভাগ্যান্ব্বেষণে দেশ ত্যাগ করে গেলেও দেশের প্রতি মায়া-মমতা, প্রেম-ভালোবাসা, দায়বোধের কোনো রকম কমতি হয় না। অথবা নিজেকে দেশ পরিত্যক্ত বা অবাঞ্ছিত মনে করে না। বরং এ ক্ষেত্রে ঘটে থাকে এর বিপরীত। ভাগ্য অন্বেষণে দেশ ছেড়ে পরবাসী হবার কারণে দেশের প্রতি মায়া-মমতা, প্রেম-ভালোবাসা যেন চক্রবৃদ্ধি হারে বৃদ্ধি পায়। দেশে রেখে যাওয়া মা-বাবা, বোন-ভাই, আত্মীয়স্বজনের প্রতি দায়িত্ব পালন করে পরিবারের প্রধান হিসেবে। দেশে রেখে যাওয়া স্বজনদের জীবন সুন্দর করে গড়ে তোলার কারিগর হিসেবে তারা বলতে গেলে জীবনের সবটুকু বিলিয়ে দেয় বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের পেছনে। শুধু পরিবার বা আত্মীয়স্বজন নয়; এমনকি দেশের দূরাত্মীয় বন্ধুবান্ধব এমনকি অনাত্মীয়ের প্রতি বাড়িয়ে দেয় অর্থনৈতিক সহযোগিতার হাত। দেখা যায়, নিজের জীবনের নিতান্ত প্রয়োজনের ব্যয়ভারটুকু রেখে আয়ের সিংহভাগ দেশে পাঠাচ্ছে নিয়মিত। আর এ কারণেই আজ বাংলাদেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড হলো বিদেশে অবস্থানরত বাংলাদেশের শ্রমজীবী মানুষের পাঠানো বৈদেশিক মুদ্রা। ২০১৫ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা গ্রহণের পরিমাণ ছিল ১৫ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার। যার সিংহভাগ প্রেরণ করে মধ্যপ্রাচ্যে কর্মরত শ্রমজীবী বাংলাদেশি নাগরিকরা। বাকি অংশ সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়া বাংলাদেশের ইমিগ্র্যান্ট নাগরিকরা। যেহেতু মধ্যপ্রাচ্যের মতো দেশগুলোয় বহির্বিশ্ব থেকে আগত শ্রমিকদের ইমিগ্রেশন দেওয়ার বিশেষ কোনো আইন নেই, তাই তাদের জন্য এখন একটি নতুন শব্দের ব্যাপক ব্যবহার দেখা যাচ্ছে। এদের বলা হচ্ছে ডায়াসপোরা পপুলেশন। আনুমানিক ১ দশমিক ২ মিলিয়ন বাংলাদেশি শ্রমজীবী মানুষ কর্মসংস্থানে আছে সৌদি আরব। সৌদি আরব ছাড়াও পারসিয়ান গালফের আরব দেশগুলোয় (Arab States of the Persian Gulf) উন্নত দেশগুলো বিশেষ করে যেসব দেশের জনসংখ্যা দেশের প্রয়োজনের তুলনায় কম, সেসব দেশের ইমিগ্রেশন আইন কিছুটা শিথিল। যেসব দেশে ইতোমধ্যে পর্যাপ্ত ইমিগ্র্যান্টের অনুপ্রবেশ ঘটে গেছে, সেসব দেশে ইমিগ্রেশন আইন পূর্বের তুলনায় বর্তমান সময়ে কঠিনভাবে নিয়ন্ত্রিত।

সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত বাংলাদেশের তরুণরা যে সময়ে কানাডা পৌঁছেছিল ইমিগ্রেশনের উদ্দেশ্যে, সেই সময়কে আজকের সঙ্গে তুলনা করলে মনে হবে, তখন ইমিগ্রেশন পাওয়া অনেকটা সহজলভ্য ছিল অথবা কানাডা প্রবেশের জন্য ভিসা পাওয়া। ১৯৬০ সাল পর্যন্ত কানাডার এক-তৃতীয়াংশ নাগরিক ছিল ব্রিটিশ ও ফ্রেঞ্চ বংশোদ্ভূত। এরা সুদীর্ঘ সময় অহংকারের সঙ্গে তাদের ভাষা, সংস্কৃতি ও খাদ্যাভ্যাস লালন করে কানাডার সমাজ ব্যবস্থায়। এবং এ দুই দেশ থেকে আগত ইমিগ্র্যান্টরা ক্রমান্বয়ে কানাডার আদিবাসীদের কোণঠাসা করতে করতে এক সময় দখল করে রাষ্ট্রক্ষমতা। যেমন করে পৃথিবীর সর্বত্র ব্রিটিশরা উপনিবেশ গড়ে তুলেছিল; সেই একই নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা ব্যবহার করে।

১৯২৮ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত কানাডা সরকার এক মিলিয়ন ইমিগ্র্যান্ট গ্রহণ করেছিল। তাদের বলা হতো ফরম দ্য বোট অথবা পায়ার ২১ কাণ্ড। পরবর্তী সময়ে উল্লেখযোগ্য হারে ইমিগ্র্যান্টদের আগমন ঘটেছে চীন, ফিলিপাইন ও ভারত থেকে। ২০০৬ সালে কানাডা ২৩৬,৭৫৬ ইমিগ্র্যান্ট গ্রহণ করে। এর মধ্যে প্রধান ১০টি দেশ ছিল পিপলস রিপাবলিক অব চায়না, (২৮৮৯৬ জন), ভারত (২৮৫২০ জন), ফিলিপাইন (১৯৭১৮ জন), পাকিস্তান (৯৮০৮ জন), যুক্তরাষ্ট্র (৮৭৫০ জন), গ্রেট ব্রিটেন (৭৩২৪ জন), ইরান (৭১৯৫ জন), দক্ষিণ কোরিয়া (৫৯০৯ জন), কলম্বিয়া ( ৫৩৮২ জন), শ্রীলংকা (৪০৬৮ জন)। ইমিগ্র্যান্ট গ্রহণের দেশগুলোর পরবর্তী অবস্থানে আছে ফ্রান্স (৪০২৬ জন), মরক্কো (৪০২৫ জন), রাশিয়া, রুমানিয়া ও আলজেরিয়া সম্মিলিতভাবে (৩৫০০ জন)।

তবে আজও বাংলাদেশের ইমিগ্র্যান্টদের সংখ্যা ওপরের দেশগুলোর ইমিগ্র্যান্টদের তুলনায় অতি নগণ্য। আজও কানাডায় বাংলাদেশি ইমিগ্র্যান্টদের বলা হয় ভিজিবল মাইনরিটি, অর্থাৎ দৃশ্যমান সংখ্যালঘু। যদিও এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম হচ্ছে যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশি ব্রিটিশ নাগরিকের সংখ্যা। ২০০৯-এর জনসংখ্যা জরিপে যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশি ব্রিটিশ অধিবাসীর সংখ্যা ৫০০,০০০। ব্রিটিশ বাংলাদেশি এই জনসংখ্যার প্রধান অংশ বসত করে ইস্ট লন্ডনে। আর ৯৫ শতাংশ ব্রিটিশ বাংলাদেশি বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চল থেকে আগত এবং তারা সিলেটি আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলে। বর্তমানে এদের বলা হয়ে থাকে সিলেটি ডায়াসপোরা।

যুক্তরাজ্যের পর বাংলাদেশি অভিবাসীর দ্বিতীয় উল্লেখযোগ্য দেশ যুক্তরাষ্ট্র। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক সিটি। এ সিটিতে সিলেটের জনগোষ্ঠী ছাড়াও চিটাগং, নোয়াখালী, ফরিদপুর, বরিশাল, খুলনাসহ অন্যান্য অঞ্চলের বাংলাদেশি ইমিগ্র্যান্টরা উল্লেখযোগ্য হারে বসত করছে। এমন নয় যে, বাংলাদেশি নাগরিকদের সবাই এসব দেশের নাগারিকত্ব অর্জন করে নিশ্চিন্তে বসত করছে। যারা নাগরিকত্ব অথবা ইমিগ্রেশন অর্জন করতে পারেনি, তাদের বিরাট অংশ যাপন করছে এক অনিশ্চিন্ত জীবন। অর্থাৎ তারা বসতের স্থায়ী আবেদন করে অপেক্ষায় আছে। অস্থায়ী বসতের অনুমতিপ্রাপ্ত হয়ে বসত অর্থাৎ একটা অনিশ্চিত ভবিষ্যতের অপেক্ষা। তারা জানে না বসতের অনুমতি অর্থাৎ ইমিগ্রেশন, গ্রিনকার্ড, পিআর কার্ড আদতে তারা পাবে কি পাবে না! কারও কারও বসতের আবেদন বাতিল হয়ে গেছে। তারা মানবিক ভিত্তিতে বসতের অধিকার আবেদন করে অপেক্ষায় আছে। এমন অনিশ্চিত পরিস্থিতি রিফুজি অথবা ইমিগ্রেশনের জন্য আবেদনকারীর জন্য ভয়ংকর ক্ষতিকর। এই অনিশ্চয়তা ক্ষতি করে আর্থিক, শারীরিক, মানসিক- সব দিকের।

কানাডায় এমন ক্ষতির সম্মুখীন রিফিউজি ক্লেইমেন্ট আছে অসংখ্য। এমনও রিফুজি ক্লেইমেন্ট আছে কানাডা অথবা আমেরিকার নিউইয়র্কে, যারা বসত করছে দশ, বারো অথবা পনের বছরের অধিক সময়। আজও ইমিগ্রেশন অর্থাৎ পিআর কার্ড, গ্রিনকার্ড পাওয়ার কোনো নিশ্চয়তা নেই। কেস গ্রহণ, না বাতিল হবে, জানে না। একখানি জুজুর ভয় তারা লালন করে সব সময়- এই বুঝি পুলিশ এসে দরজার কলিং বেল বাজাল! দরজা খোলার পর বলল, এসো, তোমাকে এয়ারপোর্ট যেতে হবে। তোমাকে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে তোমার কান্ট্রি অব অরিজিন- জন্মভূমিতে। দিনের পর দিন অনিশ্চিত ভবিষ্যতের যন্ত্রণা সহ্য করতে করতে আত্মহত্যার ঘটনাও বিরল নয়।

দলবদ্ধভাবে বসত; এটাই সমাজবদ্ধ মানুষের সামাজিক চরিত্র। এদিক থেকে এগিয়ে আছে বাংলাদেশি কমিউনিটির মানুষ কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রে। ইমিগ্রেশন উপন্যাস লেখার পরিকল্পনা মাথায় আসতেই খুব নিকট থেকে দীর্ঘদিন আমি গভীর পর্যবেক্ষণ করেছি টরন্টো, মন্ট্রিয়াল ও অটোয়ায় গড়ে ওঠা আমাদের কমিউনিটি। পৃথিবীর সব দেশ; যেখানেই বাংলাদেশিদের ইমিগ্রেশন ঘটেছে, সেখানেই গড়ে উঠেছে আমাদের লিটল বাংলা অথবা বাংলাদেশের বাইরে খুুদে বাংলাদেশ। এই লিটল বাংলা অথবা বাংলার বাইরে খুদে বাংলাদেশ যেখানেই গড়ে উঠেছে, সেখানকার মানুষ ও সামাজিক পরিবেশের রয়েছে দারুণ সখ্য। একটা কথা প্রচলিত প্রবাদের মতো- বিদেশে অপরিচিত দূরের মানুষও আপনজন হয়ে যায়। এটা শুধু বাংলাদেশিদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়; পৃথিবীর সব দেশের মানুষেরই সহজাত প্রবণতা। তাই বলতে গেলে টরন্টোতে গড়ে উঠেছে অসংখ্য জাতিগোষ্ঠীর নিজস্ব এলাকা অথবা নেইবারহুড। কানাডায় অসংখ্য ভাষা ও সংস্কৃতির মানুষ নিজেদের কমিউনিটিকে যথাযথ গুরুত্ব দেয়। কানাডা সরকার নিজেও নানা প্রকার কর্মসূচির মাধমে মাল্টিকালচারাল সোসাইটিকে গুরুত্ব প্রদান করে থাকে। কমিউনিটিদের উন্নয়নে সরকারের বাজেটের পরিমাণও বড় আকারের। মাল্টিকালচারাল কান্ট্রি হিসেবে টরন্টো আজ বিশ্বে বিশেষভাবে স্বীকৃত।

টরন্টোর ড্যানফোর্থ ও ভিক্টোরিয়া পার্ক এলাকা মূলত এখন আমাদের লিটল বাংলা। রিজেন্ট পার্ক এলাকাটিও এখন বাংলাদেশি কানাডিয়ান অধ্যুষিত। বিশাল আয়তনের একটি দেশের সিটির আকারও অনেক বড় হবে, সেটাই স্বাভাবিক। শুধু একটি সিটি নয়, কয়েকটি সিটি একত্রে গড়ে উঠেছে গ্রেটার টরন্টো। জীবন-জীবিকার প্রয়োজনে বাংলাদেশিরা ছড়িয়ে পড়েছে গ্রেটার টরন্টোর নানা সিটির নানা এলাকায়। জীবিকার প্রয়োজনে নানা সিটিতে ছড়িয়ে পড়লেও সপ্তাহ শেষে অর্থাৎ উইকএন্ডে ঝাঁকে ঝাঁকে বাংলাদেশি কানাডিয়ান ছুটে আছে নিজের পাড়ায়। শীতের তীব্রতাও তাদের আবদ্ধ করে রাখতে পারে না নিজের পাড়া বা নিজের মানুষদের কোলাহল থেকে দূরে। তাই বিকেলে সুইস বেকারিতে জমে ওঠে চা, শিঙাড়া, ডালপুরির সঙ্গে নানা বিষয়ের আড্ডা। ড্যানফোর্থে আছে আমাদের দেশীয় পণ্যে পরিপূর্ণ গ্রোসারি স্টোরের সমারোহ। আছে আমাদের ঐতিহ্য বহন করা দেশি পিঠা, মিষ্টি, বিরিয়ানি, পোলাও, কোর্মা থেকে শুরু করে ভর্তা-ভাজি, ডাল, গুঁড়া মাছের চচ্চড়ির রেস্টুরেন্টের সারি। আছে ঝাল-মুড়ি, ডালপুরি থেকে শুরু করে চটপটি, হালিমের আড্ডা জমে ওঠা উইকএন্ডের বিকেল। অথবা রমজানের সময় ইফতারের আয়োজন। মসজিদ, মন্দির, চার্চ ভরে ওঠে কানায় কানায় ধর্মীয় উৎসবের সময়। ধর্মীয় সম্প্রীতির এমন মিলনভূমি পৃথিবীতে বিরল।

প্রথম পর্বে আগত ইমিগ্র্যান্টদের প্রথম জেনারেশন সন্তান-সন্ততি এখন বড় হয়েছে। প্রথম পর্বে আগত ইমিগ্র্যান্টরা যখন আসে তখন তাদের পায়ে পায়ে হোঁচট খেতে হয়। প্রধানত ভাষার উচ্চারণ অথবা বোঝার জটিলতায়। পাকাপোক্ত বাংলা ভাষার কণ্ঠ, জিহ্বা নিয়ে যখন তারা এই ইংরেজি অথবা ফ্রেঞ্চ ভাষার দেশে এসে বসত গড়ে তোলে তখন তাদের প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায় একসেন্ট অর্থাৎ উচ্চারণের ধারা।

ফলে দেখা যায়, উচ্চশিক্ষিত বহু ব্যক্তি কানাডায় ব্যবহূত ইংরেজির অনুকরণে ইংরেজি উচ্চারণ করতে না পারায় কর্মস্থলেও বাধাপ্রাপ্ত হয়। অথবা নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে পারে না। বলা ও বোঝা দুটো ক্ষেত্রেই এ সমস্যা মোকাবিলা করতে হয়।

দ্বিতীয় প্রজন্মকে এ সমস্যার মুখোমুখি হতে হয় না। তাদের কচি জিহ্বা এবং শ্রবণ ইন্দ্রিয় পটু হয়ে ওঠে ইংরেজি ভাষায়। কারণ ইংরেজি এই প্রজন্মের জন্য এখন তা হয়ে যায় প্রথম ভাষা বা ফার্স্ট ল্যাঙ্গুয়েজ। এই প্রজন্ম টরন্টোর গ্রেটার সিটিগুলো ছাড়াও ছড়িয়ে গেছে অন্টারিও প্রদেশ এবং অন্যান্য প্রদেশের নানা সিটিতে। তারা আজ কানাডার মেইন স্ট্রিম কর্মস্থলে গুরুত্বপূর্ণ নানা পেশায় নিয়োজিত। এমনকি বাংলাদেশি কানাডিয়ান অধ্যুষিত এলাকায় আমাদের প্রথম প্রজন্ম ডলি বেগম কানাডার প্রভিন্সিয়াল এমপি পর্যন্ত নির্বাচিত হয়েছেন।

টরন্টোতে অবস্থানরত বাংলাদেশি কানাডিয়ানদের লিটল বাংলা এখন জমজমাট হয়ে উঠেছে পুরাতন, নতুন অর্থাৎ দুই-তিন প্রজন্মের বাংলাদেশি কানাডিয়ানদের উপস্থিতিতে। ড্যানফোর্থ রোডের ওপর আছে বাংলাদেশি কানাডিয়ানদের বাংলাদেশ সেন্টার। বাংলাদেশের জাতীয় উৎসব, অনুষ্ঠান পালিত হয় সেখানে। এ ছাড়া উইকএন্ডজুড়ে আছে বাংলাদেশের নানা রকম সাংস্কৃতিক উৎসব। অহংকারের সঙ্গে পালিত হয় জাতীয় সব উৎসব। একটা সময় এসব অনুষ্ঠানে উপস্থিতির সংখ্যা ছিল হাতেগোনা। এখন সেখানে উপচেপড়া ভিড়।

বাংলাদেশি কানাডিয়ানদের আবেদন ও দাবির তীব্রতায় একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে। এখন ড্যানফোর্থে আছে আমাদের অহংকারের প্রতীক শহীদ মিনার। একুশে ফেব্রুয়ারির প্রথম প্রহরে ড্যানফোর্থের শহীদ মিনারের বেদিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাতে আসে শত শত বাংলাদেশি কানাডিয়ান। হয়তো টরন্টোর ড্যানফোর্থ ভিক্টোরিয়া পার্ক এলাকা তখন তুষারে ছেয়ে গেছে। হয়তো তখন বাতাসের তীব্রতায় তাপমাত্রা মাইনাস ২০ অথবা ৩০। তাতে কী? বাংলা ভাষার জন্য প্রাণ বিলিয়ে দেওয়া সেসব ভাষাশহীদের তেজি উত্তরাধিকারীদের শীতের তীব্রতা কি দমাতে পারে? শীতের তাপে পায়ের তলায় ফোসকা পড়ার ভয় উপেক্ষা করে কেউ কেউ খালি পায়ে এগিয়ে যায় শহীদ মিনারে ফুলেল শ্রদ্ধা জানাতে। বাংলাদেশি কানাডিয়ানরা শুধু নয়; অপর ভাষা-সংস্কৃতি থেকে নির্বাচিত ড্যানফোর্থ ভিক্টোরিয়া পার্ক এলাকার এমপি, এমপিপি, রাজনীতিবিদ, সমাজকর্মীরাও এসে জড়ো হন শহীদ মিনারের বেদিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করতে বাংলা ভাষার জন্য প্রাণ উৎসর্গ করা শহীদদের উদ্দেশে।

বাংলাদেশি কানাডিয়ানদের জীবনের এসব সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, আনন্দ উৎসব- জীবনের সবকিছু নিয়ে লেখার তাগিদ অনুভব করে একদিন মনে হলো, এসব ধারণ করতে হলে উপন্যাসই যথাযথ। তখন শুরু হলো উদ্দেশ্য নিয়ে ঘোরাঘুরি। শুধু কানাডার বাংলাদেশি নয়; অন্যান্য দেশ যেখানে বাংলাদেশিরা সংখ্যায় বেশি অবস্থান করছে সেখানেই গেলাম। লেখা হলো দীর্ঘ একটি উপন্যাস। নামটাও মনঃপূত হলো- ‘ইমিগ্রেশন’। এতটুকু জোর দিয়ে বলতে পারি, ভাগ্যান্ব্বেষণে ইমিগ্রেশনের জন্য বাংলাদেশ থেকে আগত সেদিনের মানুষদের জীবন এমনই ছিল। এখনও তেমনই আছে। কারণ আমিও ভাগ্যান্বেষীদের একজন হয়ে একদিন রিফিউজির তালিকায় নাম লিখিয়েছিলাম। সে কারণে ‘ইমিগ্রেশন’ উপন্যাসটির ভেতরের গল্প সব বানানো বা কল্পনার নয়। অনেকটা ডকুনভেলীয় বা দলিল ধারার উপন্যাস বলা যেতে পারে।

ইমিগ্রেশনের জন্য সেই সময়ে আসা ভাগ্যান্ব্বেষীদের জীবনের গল্পের সঙ্গে আজ বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচার করে নিয়ে আসা দুর্নীতিবাজ, অসৎ ব্যাংক লুটেরাদের কাহিনী ভিন্ন। এই লুটেরা, দুর্নীতিবাজদের গল্প তুলে ধরার জন্য নতুন উপন্যাস ‘বেগমপাড়া’ নিয়ে কাজ করছি কয়েক বছর ধরে। আশা করছি, ২০২১-এর বইমেলায় তুলে দিতে পারব প্রিয় পাঠকদের হাতে।