দর্পণ রিপোর্ট :

সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য দলমত-নির্বিশেষে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন সংবিধানের অন্যতম প্রণেতা ও গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন।

তিনি বলেন, ইতিমধ্যে তারা সাত দফার ভিত্তিতে ঐক্যের আহ্বান জানিয়েছেন। এখানে সাত দফার জায়গায় ছয় বা আট হতে পারে। সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে সবাইকে এক হতেই হবে। তা না হলে দেশ গভীর সংকটে পড়বে।

শুক্রবার রাজধানীর সুপ্রিমকোর্টের শামছুল হক চৌধুরী হলে এক মতবিনিময় সভায় তিনি এ কথা বলেন।

‘আইনের শাসন ও গণতন্ত্র’ শীর্ষক মতবিনিময় সভার আয়োজন করে বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতি।

সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি জয়নুল আবেদীনের সভাপতিত্বে ও সম্পাদক ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকনের পরিচালনায় সভায় আরও বক্তব্য দেন, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী, সিনিয়র আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন, সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক, অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল, নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না, সাংবাদিক মাহফুজ উল্লাহ, ঢাকা ট্যাক্সেস বার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আবদুল মতিন, সিনিয়র আইনজীবী সুব্রত চৌধুরী, বিএফইউজের একাংশের সভাপতি রুহুল আমীন গাজী প্রমুখ।

বর্তমান সরকারের লজ্জা ও নীতি নেই উল্লেখ করে ড. কামাল হোসেন বলেন, ‘তারা বলেছিল ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর কিছুদিনের মধ্যে সবার সঙ্গে আলোচনা করে একটা নির্বাচন করবে। এরপর ২০১৪ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত গেল নির্লজ্জভাবে তারা এখনও দেশ চালিয়ে যাচ্ছে। সরকার আমাদের উপর বসবে আর আমরা মেনে নেব? তা হতে পারে না। তাই আসুন দলমত-নির্বিশেষে একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের লক্ষ্যে সবাই ঐক্যবদ্ধ হই। বাইরের জগৎ থেকেও সবাই এটাই বলছে। সেই নির্বাচন ২০১৪ এর মতো একটি নির্বাচন না, সুষ্ঠু নির্বাচন দিতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘এ দেশে স্বৈরাচার কোনোদিন টিকে থাকতে পারবে না। এটা আমরা একবার না বহুবার প্রমাণ করেছি। দুঃখ লাগে স্বাধীনতার ৪৬ বছর পরে আবার সেই ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের কথা বলতে হচ্ছে।’

ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন প্রসঙ্গে ড. কামাল হোসেন বলেন, ‘ঐক্যের ডাক তো আমরা দিয়ে রেখেছি। ঐক্য প্রক্রিয়ার নামে বদরুদ্দোজা চৌধুরী ও আমরা সাত দফার ভিত্তিতে ঐক্যের আহ্বান জানিয়েছি। আসুন সবাই ঐক্যবদ্ধ হই।’

আইনজীবীদের আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা রাখার আহ্বান জানিয়ে ড. কামাল হোসেন বলেন, ‘আসুন সব আইনজীবী ঐক্যবদ্ধ হয়ে জেলায় জেলায় আন্দোলন ছড়িয়ে দেই।’

প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘ তার মেয়াদ মাত্র আড়াই মাস ছিল। কিন্তু তাকে অপমান করে বিদায় দিল। এতে সারা জাতিকে অপমান করা হয়েছে। সর্বোচ্চ আদালতের প্রধানকে যারা অন্যায়ভাবে এটা করেছে তারা অসাংবিধানিক কাজ করেছে। তাদের বিচার হতে হবে। আমরা বিচার করা ভুলে গেছি বলে এই অন্যায় বারবার হচ্ছে।’

ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, ‘দেশে এখন ভেজাল গণতন্ত্র চলছে। যেখানে গণতন্ত্র ভেজাল সেখানে আইনের শাসন চলতে পারে না। এই ভেজাল গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় বিচারপতি খায়রুল হকের ভূমিকা রয়েছে। সেখান থেকেই ভেজাল গণতন্ত্রের শুরু। এমন লোকের বিচার কি কখনও হবে?’

জয়নুল আবেদীন বলেন, ‘দেশের প্রেক্ষাপট হচ্ছে বিচার বিভাগের নিম্ন আদালতগুলো সরকার ও প্রশাসনের কব্জায়। সেগুলো ইচ্ছামতো পরিচালিত হচ্ছে। এটা নিয়ে আমরা শঙ্কিত। সুপ্রিমকোর্টও তাদের কব্জায় বলে মনে হচ্ছে। দেশের জনগণ সুপ্রিমকোর্টের ওপর আস্থা রাখতে পারবে কিনা সন্দেহ আছে। এমনকি দেশের প্রধান বিচারপতিকে বের করে দেয়ার পরে আইনজীবী সমাজ শঙ্কিত।’

খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, ‘গণতন্ত্র ও আইনের শাসন একে অন্যের সম্পূরক। যেখানে গণতন্ত্র থাকে না, সেখানে আইনের শাসন থাকে না। দেশে তো গণতন্ত্র এখন নির্বাসিত। এর জন্য দায়ী আওয়ামী সরকার। এর থেকে উত্তরণের পথ একটাই গণতন্ত্র কায়েম করে ভোটাধিকার দিতে হবে। শুধু পেশাজীবীদের রাস্তায় নামলে চলবে না, সব রাজনৈতিক দলগুলোকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।’

মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ‘বিএনপির নেতারা বলেন আইনি লড়াই করে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে মক্ত করবেন, করেন দেখি? আইনি লড়াইয়ে তাকে মুক্ত করা সম্ভব নয়। দেশে হাজার হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি হচ্ছে। তার কোনো বিচার নেই। আর খালেদা জিয়ার দুই কোটি টাকায় পাঁচ বছর জেল, কী আজব দেশ!’

তিনি বলেন, ‘দেশে আইনের শাসন নেই বলেই খালেদা জিয়াকে সাজা দেয়া হয়েছে। এখন তার জামিন হচ্ছে না।’

ড. শাহদীন মালিক বলেন, ‘দেশের আইনের শাসন ও গণতন্ত্র না থাকার অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে পেশাদারি সংগঠনগুলোর লেজুড়বৃত্তি আচরণ। রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে আজ সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্র বিভাজিত। এর থেকে বেরিয়ে আসতে হলে পেশাদারি সংগঠনের লেজুড়বৃত্তি কমাতে হবে।’

অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেন, ‘দেশ চলার কথা আইন অনুসারে এবং আইন প্রয়োগ হবে সমভাবে। আজকের বাংলাদেশে গুম, ক্রসফায়ার, ব্যাংক লুটের বিচার দেখি না। আবার যারা ভিন্ন মতের, সরকারের সমালোচনা করেন, তাদের বেলায় আইনের অপপ্রয়োগ হয় ঠিকই।

তিনি আরও বলেন, ‘আজকে দুঃখ লাগে, এর চেয়ে কম দুঃশাসন, অরাজকতা যখন দেশে ছিল, তখন জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়ে স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছে। অথচ আজকে এত অন্যায়, অনাচার হচ্ছে, আর কত সর্বনাশ দেখার জন্য আমরা অপেক্ষা করব। যদি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন না হলে বাংলাদেশের সংবিধানও থাকে না, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাও থাকে না।