আমাদের মৃত্যুটা আর অনিবার্য থাকবে না? শুধু কোনও দুর্ঘটনা বা প্রাকৃতিক দুর্যোগ ছাড়া আর কোনও ভাবেই মৃত্যু হবে না আমাদের? আমরা কি থামিয়ে দিতে পারব বার্ধক্যের ‘বিজয়রথ’ও? বয়সের হিসেবে বার্ধক্যে পৌঁছেও দেহে-মনে থাকতে পারব তরতাজা যুবা? অফুরন্ত হবে যৌবন? আর ২৭ বছর পর কি ‘পিতামহ ভীষ্ম’-এর মতো আমরাও ‘ইচ্ছামৃত্যু’র বর পাব?

ম্যাসাচুসেট্‌স ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি (এমআইটি)-র জেনেটিক্সের অধ্যাপক জোসে লুই কর্দেইরো ও কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিতের অধ্যাপক ও জিনতত্ত্ববিদ ডেভিড উড এমনটাই দাবি করেছেন । কোনও আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান-জার্নালে প্রকাশিত গবেষণাপত্রে নয়, কর্দেইরো ও উড এই দাবি করেছেন তাঁদের প্রকাশিতব্য বই ‘দ্য ডেথ অফ ডেথ’-এ। বইটি ইংরেজি ছাড়াও ছাপা হচ্ছে স্প্যানিশ, পর্তুগিজ ও কোরীয় ভাষায়, শীঘ্রই।

এই দুই জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ার তাঁদের বইয়ে দাবি করেছেন, ২০৪৫ সাল নাগাদ মানুষ (যার প্রজাতির নাম- হোমো সাপিয়েন্স সাপিয়েন্স) আর কোনও প্রাকৃতিক কারণে বা রোগে ভুগে মারা যাবে না। সব রকমের স্বাভাবিক মৃত্যুকে পুরোপুরি জয় করে ফেলবে মানুষ। জন্মের মতো মৃত্যুটাও আর স্বাভাবিক থাকবে না। বার্ধক্য বলতে তখন মানুষ বুঝবে রোগ। আর সেই রোগ সারিয়ে মানুষকে বার্ধক্য থেকে ফের ‘যৌবন’-এ ফেরানো যাবে।

এই অবিশ্বাস্যকে করে তুলবে আক্ষরিক অর্থেই, বিশ্বাসযোগ্য। যে পদ্ধতিকে বিজ্ঞানের পরিভাষায় বলে, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং।স্পেনের বার্সিলোনায় ইকোয়েস্ট্রিয়ান সার্কেল-এ তাঁদের এই দাবির সপক্ষে বলতে গিয়ে কর্দেইরো ও উড জানিয়েছেন, জিনের ওপর মানুষের ‘দাদাগিরি’-ই এই অসম্ভবকে সম্ভব করে তুলবে।

জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং-এর মাধ্যমে কী কী করা যাবে ?

কী করা যাবে না বললে কাজটা খুব সহজে হয়ে যায়! তালিকাটা এতই লম্বা যে, শিশুদের মধ্যেও যেমন ‘ভাল’ আর ‘দুষ্টু’রা থাকে, জিনের মধ্যেও থাকে তেমনটাই। সেই দুষ্টু শিশুকে আমরা যেমন বকেঝকে, শাসন করে ধীরে ধীরে ভাল করে তুলি, ঠিক তেমনই ‘দুষ্টু’ জিন (গুলি)-কেও আমরা ‘ভাল’, আমাদের পক্ষে ‘উপকারী’ করে তুলতে পারি জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং-এর মাধ্যমে। জিনের প্রযুক্তির জাদুতেই মরে যাওয়া কোষ, কলা (কোষের দল বা সমষ্টি, যাকে বলে টিস্যু)-গুলিকে আমাদের শরীর থেকে বের করে আনতে পারি। মৃতকে কি কেউ দেহে পুষে রাখতে চায়? শরীরের যে কোষগুলি বিগড়ে গিয়েছে, যে ভাবে চলা উচিত, ঠিক সেই ভাবে চলছে না, বরং আমাদের বিভিন্ন শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়াকে বাধা দিচ্ছে, তাদের সঙ্গে অসহযোগিতা করছে, সেই ‘মাথা বিগড়ে যাওয়া’ কোষগুলিকে আমরা জিনের প্রযুক্তি দিয়েই সারিয়ে তুলতে পারি। জিনের প্রযুক্তিটা সে ক্ষেত্রে যেন একটা ‘সংশোধনাগার’! বিগড়ে যাওয়া, বখে যাওয়া কোষগুলিকে ‘সুস্থ, সামাজিক স্রোত’-এ ফিরিয়ে এনে স্বাভাবিক করে তুলছে। স্টেম সেল দিয়ে শরীরের বিভিন্ন রোগজীর্ণ অংশ ও অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলিকে অনায়াসে সারিয়ে ফেলতে পারি। হৃদপিণ্ড, কিডনি, ফুসফুস, পাকস্থলী, অগ্ন্যাশয়ের মতো দেহের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলিকে ‘খেলতে খেলতে’ বদলে দিতে পারি, নতুন নতুন তরতাজা ‘থ্রি-ডি প্রিন্টেড’ অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দিয়ে।

দুই জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারের, তাঁদের এক জন কর্দেইরো বলে দিয়েছেন, ‘ঠিক করেই ফেলেছি, আমি মরব না।’ এও বলেছেন, ‘‘৩০ বছর পর তো আর মরার কথাটাই ভাবব না।’’

থামানো যায় নাকি বার্ধক্যের ‘বিজয়রথ’কে !

উড আর কর্দেইরো বলেছেন, ‘‘এই প্রশ্নটা অনেকটা সেই কে কাকে প্রদক্ষিণ করছে, পৃথিবীকে সূর্য নাকি সূর্যকে পৃথিবী, তার মতো। একটা সময় কেউ মানতেই চাইতেন না, পৃথিবী প্রদক্ষিণ করে সূর্যকে। সকলেই ভাবতেন, উল্টোটা হয়। সূর্য প্রদক্ষিণ করে পৃথিবীকে। সেই ধারণাটা এক দিন আমূল বদলে গেল। আগেকার ধারণাটা এখন কেউ বললে তাঁকে উপহাসের পাত্র হতে হবে।’’

আজ আমরা সবাই যেটাকে ‘হয় কখনও সত্যি?’ বলে ভাবছি, ২৭ বছর পর সেটাকেই আমরা সবাই ‘একমাত্র সত্যি’ বলে মেনে নেব। উড ও কর্দেইরোর দাবি, মৃত্যু সম্পর্কে তাঁরা আজ যা ভাবছেন, বলছেন, এক দিন সেটাই বাস্তব হবে।

কী ভাবে থামানো সম্ভব বার্ধক্যের ‘বিজয়রথ’?

কর্দেইরোর দাবি, ‘‘কেন বার্ধক্য আসে, আগে সেটা বুঝতে হবে আমাদের। যৌন কোষ ও রক্তের কোষ ছাড়া শরীরের প্রতিটি কোষেই থাকে ক্রোমোজোম থাকে ২৩ জোড়া করে। শরীরের ক্রোমোজমে যে ডিএনএ বা ডিঅক্সি-রাইবো নিউক্লিক অ্যাসিড থাকে, তার একটা ‘লেজ’ (টেল) থাকে। সেই ‘লেজ’টার নাম- ‘টেলোমেয়ার’। আমরা যতই বার্ধক্যের দিকে এগোতে থাকি, ততই আকারে ছোট হতে থাকে সেই টেলোমেয়ার। আমরা যদি সেই আকারে ছোট হয়ে যাওয়া টেলোমেয়ারকে জিন প্রযুক্তির মাধ্যমে ইল্যাস্টিকের মতো টেনেটুনে বাড়িয়ে দিতে পারি, তা হলেই বয়সের হিসেবে আমরা বার্ধক্যের দিকে এগিয়ে যেতে থাকলেও, দেহে ও মনে চিরযুবাই থাকতে পারব।’’

উড ও কর্দেইরো জানিয়েছেন, শুধুই যে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রাকৃতিক নিয়মে টেলোমেয়ারের দৈর্ঘ্য কমতে থাকে উত্তরোত্তর, তা নয়। বায়ুদূষণ, ধূমপান ও মদ্যপানের মতো বাইরের কোনও কারণও টেলোমেয়ারের দৈর্ঘ্য উত্তরোত্তর কমিয়ে দিয়ে আমাদের বার্ধক্যকে ত্বরান্বিত করতে পারে। দু’জনেরই দাবি, জিন প্রযুক্তির মাধ্যমে চিকিৎসা পদ্ধতি আগামী ১০ বছরের মধ্যেই বিশ্ব থেকে ক্যানসারকে দূরে হঠিয়ে দেবে।

কর্দেইরো জানিয়েছেন, কোষের যে মৃত্যু হয় না, তা একটি ক্যানসার কোষই প্রমাণ করে দিয়েছে। ১৯৫১-য় সার্ভাইক্যাল ক্যানসারে ভুগে মৃত্যু হয়েছিল হেনরিয়েটা ল্যাক্সের। সেই সময় তাঁর টিউমার (ক্যানসার কোষ)-টি হেনরিয়েটার শরীর থেকে বের করে এনেছিলেন সার্জেনরা। সেটি ‘এখনও জীবিত রয়েছে’, দাবি কর্দেইরোর।

তাঁরা এও জানিয়েছেন, মানুষ মৃত্যুকে জয় করতে পারলে পৃথিবীতে আর বাসযোগ্য জায়গা থাকবে না, এই ধারণাটাও একেবারে ভুল।

‘এই সবই উর্বর কল্পনাপ্রসূত।’’ বিশেষজ্ঞদের একাংশ বলছেন। আনন্দবাজার