ফাইল ছবি

সে প্রায় আড়াই হাজার বছর আগেকার কথা—গ্রীস দেশে এথেন্স নগরের একটি গরীবের ঘরে একটি কুশ্রী ছেলের জন্ম হয়। গরীবের ছেলে, পরনে তার ছেঁড়া কাপড়, দুই বেলা পেট ভরিয়া খাইতে পায় কিনা সন্দেহ—সে আবার লেখাপড়া শিখিবে কিরূপে? সে পাথরের মূর্তি গড়িতে পারিত—তাই বেচিয়া এবং অবসরমত লোকের কাছে দুকথা শিখিয়া মানুষ হইতে লাগিল। এমন সময় ক্রাইটো নামে একটি ধনী লোক এই ছেলেটির সঙ্গে আলাপ করিয়া, তাহার মিষ্ট ব্যবহারে এত খুশী হইলেন যে, তিনি তখনই নিজের খরচে তাহার পড়াশুনার ভাল ব্যবস্থা করিয়া দিলেন। সকলেই ভাবিল গরীবের ছেলে ভাল লেখাপড়া শিখিয়া, এইবার একটা ভাল চাকুরী বা ব্যবসা করিবে।

এথেন্স নগরে তখন একদল লোক থাকিত, তাহাদের ব্যবসা ছিল পণ্ডিতি করা। তাহারা লোকের কাছে পয়সা লইয়া আড্ডা খুলিত এবং সেখানে বড় বড় কথা আওড়াইয়া চুলচেরা তর্ক করিয়া, নানারকম বিদ্যার ভড়ং দেখাইত। তাহাদের বোলচালে ভুলিয়া লোকে মনে করিত, না জানি তাহারা কত বড় পণ্ডিত! একটু বয়স হইলেই সেই গরীবের ছেলে এই পণ্ডিত মহলের পরিচয় লইতে আসিলেন। মুখে মিষ্টি মিষ্টি কথা, নিতান্ত ভাল মানুষটির মতো আস্তে আস্তে প্রশ্ন করেন, যেন তিনি কিছুই জানেন না—কিন্তু তাঁহার প্রশ্নের ঠেলায় পণ্ডিতের দল অস্থির হইয়া পড়িলেন। তাঁহার সঙ্গে তর্ক করিতে গিয়া একজন পণ্ডিত এমন নাকাল হইয়া আসিলেন যে, দেখিতে দেখিতে তাঁহার নাম চারিদিকে ছড়াইয়া পড়িল। খালি পা, মোটা কাপড় পরা, খাঁদা বেঁটে গরীব লোকটিকে রাস্তায় ঘাটে সকলেই চিনিয়া ফেলিল। তিনি পথে বাহির হইলে সকলে দেখাইয়া দিত ‘ঐ সক্রেটিস’।

দেখিতে দেখিতে এইসব মূর্খ পণ্ডিতদের উপর সক্রেটিসের ঘোর অশ্রদ্ধা জন্মিয়া গেল। তিনি ভাবিতে লাগিলেন, ‘হায়, হায়, এইসব অপদার্থের হাতে পড়িয়া, এথেন্সের ছেলেগুলি একেবারে মাটি হইয়া গেল। ইহারা কেবল কথা কাটাকাটি করিতে শিখিল—কেহ জ্ঞানলাভ করিতে চায় না, মানুষের মতো মানুষ হইতে চায় না,—শুধু লোকের কাছে নাম কিনিতে চায়, ছলে বলে ক্ষমতা জাহির করিতে চায়।’

সক্রেটিস তেজের সহিত চারিদিকে বলিতে লাগিলেন, ‘এমন করিয়া কোন মানুষ বড় হইতে পারে না। কেবল টাকাকড়ি ও যশ-মানের জন্য ছুটাছুটি করিও না, ধর্ম-পথে থাক এবং জ্ঞান লাভ কর—নহিলে তোমরা অধঃপাতে যাইবে।’লোকে অবাক হইয়া গরীবের মুখে এই সকল কথা শুনিত এবং যে একবার আসিত সেই তাঁহার কথায় ও আশ্চর্য ব্যবহারে মুগ্ধ হইয়া যাইত। দেখিতে দেখিতে সক্রেটিসের অনেক বন্ধু ও শিষ্য জুটিয়া গেল। শহরের অনেক বড় বড় লোক পর্যন্ত তাঁহার কাছে যাতায়াত আরম্ভ করিল। কোন বিদেশী রাজা অনেক টাকার লোভ দেখাইয়া সক্রেটিসকে তাঁহার নিজের সভায় লইতে চাহিলেন। কিন্তু সক্রেটিস বলিলেন, ‘আমি এ অনুগ্রহ লইয়া আপনার কাছে ঋণী থাকিতে চাহি না। আমার টাকারই বা প্রয়োজন কি? এই এথেন্স সহরে অতি অল্প খরচেই দুবেলা আহার করিয়া থাকা যায়; আর কাছেই ঝরনার জল, তাহার জন্য পয়সা দিতে হয় না। সুতরাং আমার ত কোন অভাব দেখি না।’

সে সময়ে গ্রীস দেশে প্রায়ই যুদ্ধবিগ্রহ চলিত। একবার কোন এক যুদ্ধে সক্রেটিসকে পাঠান হইল। যাহারা যুদ্ধ করিতে গিয়াছিল তাহাদের মধ্যে অনেকেই দেশে ফিরিয়া, সক্রেটিসের আশ্চর্য শক্তির প্রশংসা করিতে লাগিল। ঘোর শীতের সময়ে যখন বরফে সকল দিক ঢাকিয়া ফেলে, লোকেরা কম্বলের জামা গায় দিয়াও শীতে কাঁপিতে থাকে, সক্রেটিস তাহার মধ্যে খালি পায়ে সামান্য কাপড় পরিয়া অনায়াসে ঘুরিয়া বেড়াইতেন। ডেলিয়ামের যুদ্ধে যখন শত্রুপক্ষ সক্রেটিসের দলকে হটাইয়া দিল, তখনকার একজন প্রসিদ্ধ যোদ্ধা বলিয়াছেন, সেই বিপদের সময়েও সক্রেটিসের শান্ত চেহারা ও নিশ্চিন্ত হাসিমুখ দেখিয়া এথেন্সের লোকদের মনে আবার সাহস ফিরিয়া আসিল। শত্রুপক্ষের সৈন্যরা চারিদিকে মারধর করিতেছিল কিন্তু সক্রেটিসের কি আশ্চর্য তেজ, তাঁহার কাছে ঘেঁসিতেও কেহ সাহস পায় নাই।

সক্রেটিস নিজে গরীবের গরীব কিন্তু সারাজীবন সকলকে বিনা পয়সায় শিক্ষা দিতেন। এত বড় পণ্ডিত, কিন্তু তাঁহার মধ্যে অহংকারের লেশমাত্র ছিল না। কেহ তাঁহাকে রাগ করিয়া কথা বলিতে শুনে নাই; নিজের সামান্য কর্তব্যটুকুও অবহেলা করিতে দেখে নাই। শত্রুমিত্র সকলের জন্য মুখে তাঁহার হাসিটুকু লাগিয়াই থাকিত। কেহ কড়া কথা বলিলে বা মিথ্যা গালাগালি করিলেও তিনি তাহাতে বিরক্ত হইতেন না। কত দুষ্ট লোকে তাঁহার উপদেশ শুনিতে গিয়া কাঁদিয়া ফিরিত, তাঁহার মুখের একটি কথায় কত অন্যায়, কত অত্যাচার থামিয়া যাইত। দুঃখ বিপদের সময় কতদূর হইতে কত লোকে তাঁহার পরামর্শ শুনিবার জন্য ছুটিয়া আসিত। ‘যাহা ন্যায় বুঝিব তাহাই করিব’ একথা তাঁহার মুখেই শোভা পাইত; কারণ তাঁহার যেমন কথা তেমনি কাজ। এমন সাধু লোককে যে সকলে ভালবাসিবে, ঋষি বলিয়া ভক্তি করিবে তাহাতে আশ্চর্য কি? কিন্তু সক্রেটিসেরও শত্রুর অভাব ছিল না। একদল লোক—কেহ হিংসায় কেহ রাগে কেহ নিজের স্বার্থের জন্য—সর্বদা তাঁহার অনিষ্ট করার চেষ্টা করিত। সক্রেটিসকে সেকথা জানাইলে তিনি তাহা হাসিয়াই উড়াইয়া দিতেন।

একবার সে দেশের শাসনকর্তারা তাঁহাকে হুকুম দিলেন ‘আমরা অমুককে সাজা দিব, তুমি তাহার খোঁজ করিয়া দাও।’ সক্রেটিস তাহাদের মুখের উপর বলিলেন, ‘আমি অন্যায় কাজে সাহায্য করি না।’ শাসনকর্তারা চটিলেন। আর একবার এথেন্সের লোকেরা কয়েকজন সেনাপতির উপর ক্ষেপিয়া, জুলুম করিয়া বিনা বিচারে তাহাদের মারিতে চাহিয়াছিল, একমাত্র সক্রেটিস ছাড়া সে কার্যে বাধা দিতে আর কাহারও সাহস হয় নাই। এ ব্যাপারেও তাঁহার অনেক শত্রু জুটিল। পণ্ডিতের দল আগে হইতেই ক্ষেপিয়া ছিল। তারপর যখন চারিদিক হইতে নানা শ্রেণীর লোকে সক্রেটিসের কাছে ঘন ঘন যাতায়াত করিতে আরম্ভ করিল, তখন শাসনকর্তারা ভাবিলেন, ইহার মনে নিশ্চয়ই কোন মতলব আছে—এ হয়ত কোনদিন এই সকল লোককে ক্ষ্যাপাইয়া একটা গোলমাল বাধাইয়া তুলিবে। তাঁহারা সক্রেটিসকে শাসাইয়া দিলেন, ‘খবরদার, তুমি এথেন্সের যুবকদের সঙ্গে আর কথাবার্তা বলিতে পারিবে না।’সক্রেটিস তাহাতে ভয় পাইবেন কেন? তিনি পূর্বেরই মতো উৎসাহে সকলকে শিক্ষা দিতে লাগিলেন— ‘যাহারা জ্ঞানের অহংকার করিয়া বেড়ায় তাহারাই যথার্থ মূর্খ, যাহারা অন্যায় করিয়া দেশের আইনকে ফাঁকি দেয়, তাহারা জানে না যে ভগবানের কাছে ফাঁকি চলে না। যে মানুষ খাওয়া-পরায় অল্পতেই সন্তুষ্ট, সহজভাবে সরল কথায় সৎচিন্তায় সময় কাটায়, সেই সুখী—আধপেটা খাইয়াও সুখী; মানুষের নিন্দা অত্যাচারের মধ্যেও সুখী।’ এমনি করিয়া ঋষি সক্রেটিস ৭২ বৎসর বয়স পর্যন্ত যুবকের মতো উৎসাহে নিজের কাজ করিয়া গেলেন।

ইহার মধ্যে সক্রেটিসের শত্রুপক্ষ ষড়যন্ত্র করিয়া তাঁহার নামে মিথ্যা নিন্দা রটাইয়া এথেন্সের বিচার সভায় তাঁহার বিরুদ্ধে অন্যায় নালিশ উপস্থিত করিল। শত্রুর দল যে যেখানে ছিল সকলে হাঁ হাঁ করিয়া সাক্ষ্য দিতে আসিল—‘সক্রেটিস বড় ভয়ানক লোক, সে এথেন্সের সর্বনাশ করিতেছে।’ অন্যায় বিচারে হুকুম হইল ‘সক্রেটিসকে বিষ খাওয়াইয়া মার।’ সক্রেটিসের বন্ধুরা বলিলেন, ‘হায় হায়, বিনা দোষে সক্রেটিসের শাস্তি হইল।’ সক্রেটিস হাসিয়া বলিলেন, ‘তোমরা কি বলিতে চাও যে আমি দোষ করিয়া সাজা পাইলেই ভাল হইত?’

সক্রেটিসকে কয়েদ করিয়া রাখা হইল, কবে তাঁহাকে বিষ খাওয়ান হইবে সেদিনও স্থির হইল। জেলের অধ্যক্ষ সক্রেটিসের ভক্ত ছিলেন, তিনি বন্ধুদের সঙ্গে পরামর্শ করিলেন সক্রেটিসকে রাতারাতি এথেন্সে হইতে সরাইয়া ফেলিবেন; কিন্তু সক্রেটিস তাহাতে রাজি হইলেন না। তিনি বলিলেন, ‘আমার দেশের লোকে বিচার করিয়া বলিয়াছেন আমার শাস্তি হউক। আমি সে শাস্তিকে এড়াইয়া দেশের আইনকে অমান্য করিতে চাই না।’ ক্রমে দিন ঘনাইয়া আসিল। সক্রেটিসের বন্ধুরা কাঁদিতে কাঁদিতে ফিরিয়া গেলেন, কেহ কেহ রাগে দুঃখে এথেন্স ছাড়িয়া চলিয়া গেলেন—মহাপণ্ডিত প্লেটো প্রভৃতি কয়েকটি শিষ্য শেষ পর্যন্ত তাঁহার কাছেই বসিয়া রহিলেন। সক্রেটিসের প্রশান্ত মুখে ভয়ের চিহ্নমাত্র নাই, তিনি সকলকে আশ্বাস দিতেছেন, উৎসাহের সঙ্গে বলিতেছেন,‘দেহ নষ্ট হইয়া যায়, কিন্তু দেহের মধ্যে যে থাকে সে অমর—এই দেহে যখন প্রাণ থাকিবে না, আমি তখনও থাকিব।’একজন শিষ্য বলিলেন, ‘মৃত্যুর পর আপনাকে কোথায় কবর দিব?’ সক্রেটিস বলিলেন, ‘যেখানে ইচ্ছা; কিন্তু মৃত্যুর পর আমায় পাইবে কোথায়?’এমন সময় জেলের প্রধান কর্মচারী কাঁদিতে কাঁদিতে বিষের পাত্র আনিয়া ধরিল এবং সক্রেটিসের কাছে ক্ষমা চাহিল। সক্রেটিস তাহাকে আশীর্বাদ করিয়া, হাসিমুখে বিষ পান করিলেন। তারপর শিষ্যদের সহিত কথা বলিতে বলিতে ক্রমে তিনি অবসন্ন হইয়া পড়িলেন। দেখিতে দেখিতে তাঁহার হাত পা অবশ হইয়া আসিল। শেষে মৃত্যু আসিয়া মহাপুরুষের জীবন শেষ করিয়া দিল। সক্রেটিস মরিয়া অমর হইলেন; তাঁহার নাম চিরকালের  জন্য পৃথিবীর ইতিহাসে থাকিয়া গেল।