গনেশ চন্দ্র হাওলাদার :

শুভ জন্মাষ্টমী, সনাতন ধর্মের মহাবতার ভগবান শ্রীকৃষ্ণের শুভ জন্মতিথি। দ্বাপর যুগের সন্ধিক্ষণে ভাদ্র মাসের কৃষ্ণপক্ষের অষ্টমী তিথিতে শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাব ঘটেছিল এই মাটির ধরাধামে। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের অপ্রাকৃত লীলাকে কেন্দ্র করেই জন্মাষ্টমী উৎসব। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কাছে এ উৎসবের তাৎপর্য অপরিসীম।

আজ থেকে প্রায় পাঁচ হাজার বছর পূর্বে দ্বাপর যুগে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ দুষ্টের দমন আর শিষ্টের পালনে ভাদ্র মাসের কৃষ্ণপক্ষের এক প্রলয়ংকারী ঝড় বৃষ্টির রাতে মথুরার তৎকালীন রাজা কংসের কারাগারে মাতা দেবকী আর পিতা বসুদেবের অষ্টম সন্তানরূপে আবির্ভূত হয়েছিলেন যুগোপুরুষোত্তম ত্রিলোক পূজিত পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ। তাঁর আগমনে ধরাধাম হয়েছিল পাপমুক্ত, জয় হয়েছিল সত্যের, জয় হয়েছিল ধর্মের।

পৃথিবীর মানুষদের মধ্যে বিশেষ করে যারা ধর্মাত্মা, সদাচারী, নিরপরাধ তাদের ওপর পাপী, দুরাচার, বলবান ব্যক্তিদের অত্যাচার বৃদ্ধি ও অন্যায়ের মাত্রা সত্য সুন্দর ও পবিত্রতাকে গ্রাস করতে উদ্যত হয়েছিল, তখন সেই অসুন্দরকে দমন ও বিনাশ করে মানবজাতিকে রক্ষা এবং শুভ শক্তিকে প্রতিষ্ঠার জন্য মহাবতার ভগবান শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাব ঘটে। অবক্ষয়িত মূল্যবোধের পৃথিবীতে মানবপ্রেমের অমিত বাণী প্রচার ও প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। পরমাত্মার সঙ্গে জীবাত্মার মিলনই সে বাণীর মূল বিষয়। তাই তিনি ভক্তদের কাছে প্রেমাবতার।

এই ধরাধামে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাবকালটি ছিল খুবই বিভীষিকাময় এক দুঃস্বপ্নের যুগ, ধর্মের জন্য অবমাননাকর, প্রজাপীড়নে মত্ত অত্যাচারী রাজন্যবর্গ, মুনি-ঋষিদের ধর্ম অনুশীলনে বিঘ্ন সৃষ্টি করে মানুষের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছিল। অত্যাচারী রাজন্যবর্গের মধ্যে কংস, জরাসন্ধ, শিশুপাল এদের নাম উল্লেখযোগ্য। মগদরাজ জরাসন্ধ রাজচক্রবর্তী হওয়ার আকাংখায় ৮০জন রাজাকে বশ্যতা স্বীকারে বাধ্য করে কারাগারে বন্দী করেছিলেন। মথুরাতে মহারাজা উগ্রসেনকে কারারুদ্ধ করে তার পুত্র কংস রাজ্য দখল করেছিল। চেদিরাজ শিশুপাল ছিলেন আর একজন অত্যাচারী রাজা।। ঐ সময়ে ঐ সকল রাজাদের অত্যাচার এমন পর্যায়ে গিয়েছিল যে, প্রজাগণ নিদারুণ সঙ্কটে বন্দী জীবন যাপন করছিলেন। ধরিত্রীমাতা এসব অনাচার ও পাপাচারের প্রতিবিধানকল্পে ব্রহ্মার শরণাপন্ন হন। শ্রী বিষ্ণু তাদের প্রার্থনার ফল অনুমোদন করে পৃথিবীর পাপভার লাঘব করার জন্য ধরাধামে জন্ম নেয়ার প্রয়োজন অনুভব করেছিলেন। ব্রহ্মার অনুরোধে ভগবান বিষ্ণু দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন করে ধর্মরাজ্য প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনে এই ধরাধামে আবির্ভূত হতে সম্মত হন। এই যুগ প্রয়োজনেই শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাব।

এই সময়ে যদুবংশীয় রাজা উগ্রসেন মথুরায় রাজত্ব করতেন। তাঁরই পুত্র কংস ছিলেন অতিশয় বলবান এবং যারপরনাই খল প্রকৃতির। পিতা উগ্রসেনকে কারাবন্দী করে নিজেই সিংহাসনে বসেন এবং শক্তিমদমত্ততায় উন্মত্ত হয়ে তাঁর রাজ্যে অনাচার ও অত্যাচার-উৎপীড়নের এক বিভীষিকাময় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেন। আবার তাঁরই বন্ধু মগধের পাপাসক্ত রাজা জড়াসন্ধ ছিলেন মদমত্ত অত্যাচারী। উগ্রসেনের এক ভ্রাতা দেবকের কন্যার নাম দেবকী। ইনিই পরবর্তীকালে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের জননী হন।

কংস দেবকীকে খুবই স্নেহ করতেন। দেবকী বিবাহযোগ্যা হলে তাঁকে বসুদেবের সঙ্গে বিয়ে দেন। বসুদেব ছিলেন সত্যনিষ্ঠ, সমদৃষ্টিসম্পন্ন চরিত্রবান। এই বিয়ে খুবই জাঁকজমকপূর্ণভাবে সম্পন্ন হয়েছিল। আদরের ভগ্নি দেবকী ও বসুদেবের প্রতি বাড়তি সৌজন্য দেখাতে কংস নিজেই রথের সারথি হয়ে দেবকীকে শ্বশুরালয়ে পৌঁছে দিতে অগ্রসর হলেন। কিছুদূর এগোনোর পর কংস এক দৈববাণী শুনতে পেলেন! ‘আরে নির্বোধ! তুমি যাকে স্নেহভরে শ্বশুরালয়ে নিয়ে যাচ্ছ, তারই গর্ভের অষ্টম সন্তান তোমাকে বধ করবে।’ এ কথা শুনে কংস দিগিবদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে দেবকীকে হত্যা করতে উদ্যত হলেন। স্থিরপ্রজ্ঞ বসুদেব কংসকে বুঝিয়ে-শুনিয়ে অতিকষ্টে সাময়িকভাবে শান্ত করলেন। বসুদেব কংসকে প্রতিশ্রুতি দিলেন, দেবকীর গর্ভে যত সন্তান হবে, তা সবই জন্মের পরপরই কংসের হাতে তুলে দেবেন। দেবকী-বসুদেবের বাসস্থান নির্ধারিত হলো কংসের কারাগারের একটি ক্ষুদ্র প্রকোষ্ঠে। এভাবে কংসের রুদ্ররোষ থেকে দেবকীর জীবন রক্ষা পেল। কংস একে একে দেবকীর গর্ভজাত ছয়জন সন্তানের প্রত্যেককেই জন্মের সঙ্গে সঙ্গে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করেন। সপ্তম গর্ভে ভগবান বিষ্ণুর অংশে অনন্তদেব ভিন্ন নামে সংকর্ষণ বলরাম রূপে আবির্ভূত হলে কংসের হাতে বিনষ্ট হওয়ার আশঙ্কায় ভগবান তাঁর অচিন্তনীয় যোগমায়াবলে দেবকীর সপ্তম গর্ভ আকর্ষণ করে বসুদেবের অপর পত্নী রোহিণীর গর্ভে প্রতিস্থাপিত করেন এবং বলরামের জন্ম হয়। এসবই অসম্ভবের সম্ভব শ্রীভগবানের লীলাবিলাস। এই সংকর্ষণের ঘটনাকে সকলে মনে করলেন, দেবকীর সপ্তম গর্ভ নষ্ট হয়ে গেছে। কংসও তাই ধরে নিলেন। রোহিণী কংসের ভয়ে বসুদেবের বন্ধু নন্দের গৃহে অবস্থান করছিলেন।
ভাদ্র মাসের অষ্টমী তিথিতে রোহিণী নক্ষত্রে জয়ন্তীযোগে অর্ধচন্দ্র উদিত হলে কংসের কারাগারের ক্ষুদ্র প্রকোষ্ঠে শ্রীহরি শঙ্খ, চক্র, গদা, পদ্মশোভিত হয়ে দিব্যকলেবর ধারণপূর্বক জ্যোতির্ময় মূর্তিতে পুত্র পরিচয়ে দেবকী ও বসুদেবের সম্মুখে আবির্ভূত হলেন। শ্রীভগবানের অপরূপ রূপমাধুর্যের আলোক প্রভায় দেবকী ও বসুদেব চমৎকৃত হলেন এবং করজোড়ে স্তুতি করতে লাগলেন। অষ্টম সন্তান শ্রীকৃষ্ণ এই সুনির্মল রাতে জন্মগ্রহণ করেন।


ভগবান যোগমায়াকে বললেন, তিনি যখন মথুরায় কংসের কারাগারে দেবকীর অষ্টম সন্তান হিসেবে এই ধরাধামে আবির্ভূত হবেন, তখন যেন যোগমায়া বৃন্দাবনে নন্দপত্মী যশোদার গর্ভে আবির্ভূত হন। সবার অজান্তে ভগবান বিষ্ণুর ইচ্ছা রূপায়িত করতে যোগমায়া নন্দগৃহে যশোদার কোলে আবির্ভূত হলেন। জন্মরাত্রেই দৈবসহায়তায় কারাগার থেকে বের হয়ে বাসুদেব তাঁকে প্রমত্তা যমুনা পেরিয়ে গোকুলে তাঁর পালক মাতাপিতা যশোদা ও নন্দের কাছে রেখে শ্রীকৃষ্ণকে রেখে আসেন ও সদ্যভূমিষ্ঠ যোগমায়াকে এনে দেবকীর কোলে স্থাপিত করেন।
কিন্তু যশোদার গর্ভজাত সন্তান কারাগারে দেবকীর কোলে স্থানান্তরিত হয়েও রক্ষা পেলেন না। নিষ্ঠুর কংস দেবকীর গর্ভেও অষ্টম সন্তান কন্যা জেনেও তাঁকে হত্যা করতে দ্বিধা করেননি। তাঁকে হত্যা করতে উদ্যত হলে কন্যারূপী যোগমায়া হাসতে হাসতে কংসের হাত ফসকে অন্তর্হিতা হলেন এবং বলে গেলেন, ‘তোমাকে বধিবে যে, গোকুলে বাড়িছে সে।’

নন্দ ছিলেন গোপালক সম্প্রদায়ের প্রধান। তাঁর নিবাস ছিল বৃন্দাবনে। শ্রীকৃষ্ণের বাল্যকাল অতিবাহিত হয় বৃন্দাবনে।

তিনি ছিলেন রাখাল বালক।

 

তিনি মাখন চুরি করে দুষ্টুমি করতেন। কৃষ্ণের প্রাণনাশের জন্য কংস পুতনা সহ অন্যান্য রাক্ষসদের প্রেরণ করলে, সকলকে বধ করেন কৃষ্ণ। যমুনা নদীর বিষাক্ত কালনী নাগকে হত্যা তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য।
এরপর কৃষ্ণ বহু রাক্ষসকে বধ করে প্রবেশ করেন তার জন্মভূমি মথুরাতে। তিনি মথুরাতে দুরাচারী কংসকে হত্যা করেন। এভাবে কৃষ্ণ একে একে বাকী দূরাচারী রাজাদের হত্যা করেন। এই ধরাধামকে তিনি পাপের আধার থেকে রক্ষা করেন।


ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তাঁর জন্ম নিয়ে বলেছেন, তাঁর জন্ম সাধারণ মানুষদের মত নয় এবং তাঁর মৃত্যুও সাধারণ মানুষের মত নয়। মানুষ জন্মগ্রহণ করে এবং মারা যায় কিন্তু আমি জন্মরহিত হয়েও আবির্ভূত হই এবং অবিনশ্বর হয়েও অন্তর্ধান করে থাকি। আবির্ভূত হওয়া এবং অন্তর্হিত হওয়া-দুটিই আমার অলৌকিক লীলা।


মহাকাল ও মহাজগৎ ব্যাপ্ত হয়ে যিনি অনন্ত সর্বশক্তিমান সত্তায় শাশ্বত সত্যরূপে বিরাজিত, আমরা তাকেই ভগবান বলে থাকি। কেবল সনাতনীকল্প মণীষাতেই তিনি অষ্টোত্তর শতনামে সম্ভাসিত হয়েছেন। ভক্তরা তাকে যে নামে ডাকেন, সে নামে তিনি সাড়া দেন। যেভাবে তাকে পেতে চান, সেভাবেই তিনি ধরা দেন। সনাতনী সমাজে তার অবস্থান অনেকটা পরিবারের একজনের মত। তাই তো তিনি দেবকী ও বসুদেবের আকুল প্রার্থনায় সাড়া দিয়ে কংসের কারাগারে তাদের সম্মুখে আবির্ভূত হন পুত্ররূপে, কৃষ্ণনামে।

শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাব জগৎ কল্যাণে উদ্ভাসিত। তাঁর ত্রিবিধ শক্তিকর্ম, জ্ঞান এবং ভক্তির অভূতপূর্ব সমন্বয় মানুষের মুক্তিপথের পাথেয়, চিরপ্রবাহমান আশীর্বাদ। ব্রজলীলায় তিনি রসময় প্রেমঘন, মথুরা-দ্বারকালীলায় তিনি সর্বকৃৎ প্রতাপঘন, কুরুক্ষেত্রের রণাঙ্গনে তিনি সমরকুশলী একক নিয়ন্ত্রক এবং ন্যায়যুদ্ধের সার্থক পরিচালক, ধর্মরাজ্য স্থাপনের মহান স্থপতি, মহাগ্রন্থ শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার গীতিকার। তাঁর এসব লোকলীলার উদ্দেশ্য শুধু অসুরাদি বিনাশই নয়, আসল উদ্দেশ্য হলো ধর্ম সংস্থাপন ও ধর্মরাজ্য প্রতিষ্ঠা। ধর্মের সম্যক মর্মবাণী প্রচারে মানবাত্মার উন্নতি সাধন করে মানুষকে দিব্য জীবনে অধিষ্ঠিত করাই ছিল শ্রীভগবানের প্রকৃত অভিলাষ।

শ্রীকৃষ্ণ ভক্ত হৃদয়ের কোন কল্পিত মূর্তি নয়। একদিকে বাঁশি হাতে বৃন্দাবনের রাখাল ও অন্যদিকে ধর্মযুদ্ধে অর্জুনের সিংহনাদকারী সারথি শ্রীকৃষ্ণকে অতি মহামানব, অবতার, অবতারী যাই বলা হোক না কেন তিনি মনুষ্য দেহধারী অমিতগুণ ও শক্তির অধিকারী একজন ঐতিহাসিক পুরুষ। তিনি সৎ গৃহস্থ, রাজনীতিজ্ঞ, দাতা, বীর যোদ্ধা, ধর্মপ্রচারক ও ধর্মসংস্থাপক।
পরমেশ্বর শ্রীকৃষ্ণের গীতার বাণীতে উজ্জীবিত হয়ে একে অপরকে ভালবাসার বন্ধনে আলিঙ্গন করতে আমাদের মাঝে আসে জন্মাষ্টমী। পুতঃপবিত্র অনন্য-পূণ্যময় দিন। এ দিনের তাৎপর্য অপরিসীম। ‘সীমার মাঝে অসীমের’ আহ্বান। বন্ধনের মাঝে মুক্তির আস্বাদন। প্রতিটি সনাতন ধর্মাবলম্বী মানুষ মাত্রেই জন্মাষ্টমী উৎসবের প্রতীক্ষায় থাকে অধীর আগ্রহে। হৃদয়ে ভগবানের আবির্ভাব ঘটানোর উৎসবও এই জন্মাষ্টমী উৎসব।

সবাইকে শুভ জন্মাষ্টমীর আন্তরিক শুভেচ্ছা। জয় হোক পৃথিবীর সকল জীবের। প্রতিটি গৃহে জ্বলে উঠুক মঙ্গলদীপ, শঙ্খধ্বনিতে পূণ্যময় হয়ে উঠুক ধরা। সবাই সুখী হোক, পৃথিবীতে বয়ে যাক শান্তির অমিয়ধারা।
লেখক: সাংবাদিক।