যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে চলমান বাণিজ্যযুদ্ধে লাভবান দেশগুলোর অন্যতম বাংলাদেশ। বাণিজ্যযুদ্ধের ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের পণ্য আমদানি বেড়েছে প্রায় ১৪ শতাংশ। মার্কিন সেন্সাস ব্যুরোর সাম্প্রতিক এক পরিসংখ্যানে এ চিত্র উঠে এসেছে। যদিও দেশটিতে পণ্য রফতানির সঙ্গে জড়িতরা বলছেন, এ বাণিজ্যযুদ্ধ থেকে প্রত্যাশিত মাত্রায় সুবিধা তুলে নিতে পারেনি বাংলাদেশ।

মার্কিন সেন্সাস ব্যুরোর তথ্য বলছে, চীন-যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য সংঘাতে সবচেয়ে লাভবান হয়েছে ভিয়েতনাম। এছাড়া তাইওয়ান, বাংলাদেশ ও দক্ষিণ কোরিয়াও এর সুযোগ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে রফতানি বাড়িয়েছে। এক্ষেত্রে বাণিজ্যযুদ্ধের কারণে চীন থেকে যুক্তরাষ্ট্রের পণ্য আমদানি কমেছে ১২ শতাংশ। এর বিপরীতে একই সময়ে ভিয়েতনাম থেকে দেশটির আমদানি বেড়েছে ৩৬ শতাংশ। এছাড়া তাইওয়ান থেকে ২৩ শতাংশ, বাংলাদেশ থেকে ১৪ ও দক্ষিণ কোরিয়া থেকে ১২ শতাংশ আমদানি বাড়িয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।

দেশটির সংবাদমাধ্যমগুলো বলছে, চীন থেকে আমদানি হ্রাসের ধারাবাহিকতায় ভোক্তা চাহিদা মেটানোর জন্য স্থানীয় উৎপাদনকারীদের বদলে এশিয়ার অন্যান্য দেশের ওপরই বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে মার্কিন বাজার। এর সুবিধা নিয়েই লাভবান হচ্ছে বাংলাদেশসহ এশিয়ার অন্য কয়েকটি দেশ।

এসব প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, ট্রাম্পের শুল্ক আরোপের কারণে মার্কিন ব্যবসায়ীদের চীনের তৈরি বেজবল ক্যাপ, লাগেজ, বাইক, হ্যান্ডব্যাগ ইত্যাদি পণ্য আমদানিতে ব্যয় অনেক বেড়েছে। এছাড়া ঊর্ধ্বমুখী হয়ে উঠেছে যন্ত্রাংশ, ডিশওয়াশার, ওয়াশিং মেশিন, ড্রায়ার, ওয়াটার ফিল্টারসহ মেশিন ও শিল্পপণ্যের দামও।

যুক্তরাষ্ট্র-চীন বাণিজ্যযুদ্ধের সম্ভাব্য প্রভাব সম্পর্কে পোশাকপণ্য উৎপাদন ও রফতানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএ বলছে, গত ১৩ মে চীন থেকে আমদানি করা পণ্যে পিউনিটিভ ট্যারিফ আরোপ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। সর্বশেষ আরোপিত এ ট্যারিফের আওতায় রয়েছে প্রায় ৩০০ বিলিয়ন ডলারের চীনা পণ্য, যার মধ্যে রয়েছে পোশাক ও ফুটওয়্যার। এ নিয়ে গত সপ্তাহে ট্রাম্পের দেয়া স্থগিতাদেশ ঘোষণা কার্যকর না হলে সর্বোচ্চ ২৫ শতাংশ সীমার এ ট্যারিফ চলতি মাসের ১ তারিখ থেকে কার্যকর হওয়ার কথা রয়েছে।

বিজিএমইএ নেতারা বলছেন, দেশে রফতানির খাতগুলোয় বিশেষ করে পোশাক খাতের ওপর চীন-যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্যযুদ্ধের প্রভাব বেশ জটিল। বেশকিছু বাস্তবতার কারণেই এ জটিলতা রয়েছে। বিশেষ করে স্বল্পমূল্যের কারণে চীনা পোশাক খাত নিজে থেকেই মার্কিন শুল্ক আরোপের ধাক্কা সামলাতে সক্ষম। ফলে এখান থেকে যতটা প্রত্যাশা করা হচ্ছে, ততটা সুবিধা আদায় করে নিতে পারবে না বাংলাদেশ।

বিভিন্ন পরিসংখ্যান তুলে ধরে সংগঠনটি বলছে, কয়েক বছর ধরেই যুক্তরাষ্ট্রে চীনের পোশাক রফতানি এমনিতেই নিম্নমুখী ধারায় রয়েছে। ২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রে সরবরাহকৃত পোশাকের ৩৩ শতাংশেরই উৎস ছিল চীন। মূলত বাড়তি উৎপাদন খরচ ও উচ্চমূল্যের পণ্য উৎপাদনে মনোযোগী হওয়ার কারণে দেশটির পোশাক রফতানিতে এ ক্রমহ্রাসমান ধারা দেখা গেছে। বিশেষ করে ২০১৫-২০১৮ সাল পর্যন্ত সময়ের পরিসংখ্যান বলছে, এ চার বছরে যুক্তরাষ্ট্রে চীনা পোশাকের রফতানি কমেছিল ১০ দশমিক ৩৯ শতাংশ, আর্থিক মূল্য বিবেচনায় যার পরিমাণ দাঁড়ায় ৩১৭ কোটি ডলারে। অন্যদিকে একই সময়ে যুক্তরাষ্ট্রে চীন থেকে সুতা রফতানি বেড়েছে ২৮ দশমিক ২৯ শতাংশ হারে। এর মধ্য দিয়েই চীনের পোশাকের বদলে বাড়তি মূল্যের ইন্টারমিডিয়েট পণ্য উৎপাদনে অতিরিক্ত মনোযোগী হয়ে ওঠার বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যায়।

এছাড়া গোটা বিশ্ব থেকে যুক্তরাষ্ট্রের আমদানীকৃত পোশাকের ইউনিটপ্রতি মূল্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, দেশটিতে সবচেয়ে কম দামে পোশাক সরবরাহ করে চীন। চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত প্রকাশিত তথ্যমতে, যুক্তরাষ্ট্রে সরবরাহকৃত চীনা ক্ষুদ্র-মাঝারি পণ্যের আমদানি মূল্য ২ ডলার ৩০ সেন্ট। অন্যদিকে বাংলাদেশ থেকে সরবরাহ করা পণ্যের আমদানি মূল্য ২ ডলার ৭৯ সেন্ট। এছাড়া কম্বোডিয়া ও হন্ডুরাস থেকে সরবরাহকৃত এসএমই পণ্যের আমদানি মূল্য যথাক্রমে ২ দশমিক ৫২ ডলার ও ২ দশমিক ৭ ডলার। সব মিলিয়ে বলা চলে, চীনা স্বল্পমূল্যের পণ্য নিজে থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কের ধাক্কা মোকাবেলা করতে সক্ষম।

এছাড়া রফতানি পণ্যের মূল্য বিশ্লেষণে আরো দেখা যায়, ২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রে চীনা পোশাকের রফতানি মূল্য কমেছে ১ দশমিক ৩৭ শতাংশ। চলতি বছরের প্রথম চার মাসে (জানুয়ারি-এপ্রিল) এ মূল্যহ্রাসের হার দাঁড়িয়েছে ১ দশমিক ৮৫ শতাংশে। অন্যদিকে গত বছর যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশী পণ্যের রফতানি মূল্য বেড়েছে ২ দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ। চলতি বছরের প্রথম চার মাসেও এ ঊর্ধ্বমুখিতা বজায় ছিল। এ সময় দেশটিতে বাংলাদেশী পণ্যের রফতানি মূল্য বেড়েছে ১ দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ। এর মধ্য দিয়ে শুল্ক ধাক্কা মোকাবেলায় চীনা পোশাক শিল্পের মূল্য সক্ষমতার বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

এ বিষয়ে বিজিএমইএ সভাপতি ড. রুবানা হক বলেন, বাণিজ্যযুদ্ধে বাংলাদেশের সম্ভাবনাকে বিবেচনায় নিলে যুক্তরাষ্ট্রে চীন ও বাংলাদেশের রফতানি পণ্যের সামঞ্জস্যতা দেখতে হবে। একটি বিশ্লেষণে দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্রে চীনের রফতানীকৃত শীর্ষ ৩০ পণ্যের মধ্যে বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা করছে ১৬টি নিয়ে। ২০১৪-২০১৮ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে চীন থেকে ওই ১৬ পণ্যের রফতানি কমেছে ১১ দশমিক ৮৪ শতাংশ। একই সময়ে বাংলাদেশেরও হ্রাস পেয়েছে ১২ দশমিক ২৮ শতাংশ। অন্যদিকে ভিয়েতনামের প্রবৃদ্ধি ছিল ১৬ দশমিক ৮২ শতাংশ।

তিনি আরো বলেন, সব তথ্য বিশ্লেষণ করে সারাংশে বলা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চীনের পোশাকের বাণিজ্যে অতিরিক্ত শুল্কের প্রভাব পড়বে ঠিকই। কিন্তু এখানে অন্যান্য কিছু ফ্যাক্টর আছে, যা এ ধাক্কা সামলে নিতে সহায়তা করবে। ফলে যেভাবে প্রত্যাশা করা হয়েছিল, যুক্তরাষ্ট্র আরোপিত অতিরিক্ত শুল্ক বাংলাদেশের জন্য ততটা সুবিধা বয়ে আনবে না।