মো. ইব্রাহীম
কি ভয়ঙ্কর! হার্ট ব্রেক হওয়ার অবস্থা। যুক্তরাষ্ট্রে কৃষ্ণাঙ্গ নাগরিক জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যুতে বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে বিক্ষোভ। আর এ বিক্ষোভের আঁচ প্রতিবেশী দেশ মেক্সিকোতে পড়বে তা তো স্বাভাবিক। বিক্ষোভও হচ্ছে যথারীতি শৃঙ্খলার সঙ্গে। কিন্তু এরই মধ্যে দেখা গেল প্রকাশ্য দিবালোকে এক পুলিশ সদস্যের গায়ে বিক্ষোভকারীরা পেট্রল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়। কত ভয়ঙ্কর, কত হিংস্র, কত বর্বর- তাই তো মনে হচ্ছে এ মানুষগুলোকে। কিন্তু এর আগে পুলিশও কম হিংস্রতা, বর্বরতা দেখায়নি। কয়েকদিন আগে গিওভানী লোপেজ নামের ৩০ বছরের এক ব্যক্তির পুলিশি হেফাজতে মৃত্যু হয়। পরে একটি ভিডিওতে দেখা যায়, লোপেজকে গ্রেফতার করতে জর্জ ফ্লয়েডের মতো একই ধরনের শারীরিক অত্যাচার করেছে পুলিশ। মূলত এ ভিডিওটি প্রকাশ্যে আসার পরই নতুন করে বিক্ষোভের আগুন জ¦লছে মেক্সিকোতে।

যুক্তরাষ্ট্রের মিনিয়াপোলিস শহরে গত ২৬ মে পুলিশের হাতে নির্মমভাবে শ্বাস বন্ধ হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে কৃষ্ণাঙ্গ নাগরিক জর্জ ফ্লয়েড। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল তিনি ২০ ডলারের একটি জাল নোট দিয়ে সিগারেট কেনার চেষ্টা করেছিলেন। অভিযোগকারীর ফোন পেয়ে পুলিশ আসে। শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যের সমাজে জর্জ ফ্লয়েডের অপরাধ অমার্জনীয় ও মৃত্যুণ্ডের শামিল। তাই তো জর্জ ফ্লয়েডের ঘাড়ে পা দিয়ে চেপে ধরে মিনিয়াপোলিস শহরের পুলিশ। ফলাফল ফ্লয়েডের মৃত্যু। জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যুর পর গোটা আমেরিকায় বর্ণবাদবিরোধী বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। যে আন্দোলনের নাম দেয়া হয় ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’। অনেক জায়গায় বিক্ষোভ সহিংসতায় রূপ নেয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অতিবল প্রয়োগ, সংঘর্ষ এবং বিক্ষোভকারীরা ঐতিহাসিক নেতা বা বিখ্যাত ব্যক্তিত্বদের ভাস্কর্য ভাঙচুর করার ঘটনাও ঘটেছে। বিক্ষোভকারীদের মুখে শোনা যায় জর্জের শেষ শব্দগুলো- ‘আমি শ্বাস নিতে পারছি না’। যেটা এর আগে দেখা গেছে ২০১৪ সালে সিরিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের বোমা হামলায় বিধ্বস্ত বাড়ির দেয়ালের নিচে চাপা পড়ে থাকা এক সিরিয়ান শিশুকে। ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে আর্তনাদ করতে করতে মারা যাওয়া সেই সিরিয়ান শিশুর শব্দ সভ্য সমাজের কানে যায়নি। যদি যেত তাহলে আজ পৃথিবী আরো সুন্দর থাকত। প্রতিটি হত্যাই অনাকাক্সিক্ষত ও অপ্রত্যাশিত যদি পৃথিবীর প্রতিটি প্রান্ত থেকে ধ্বনিত হতো তাহলে আজ জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যু পায়ের নিচে চাপা পড়ে হতো না।

তারা এখন উপলব্ধি করতে শুরু করেছে- বর্ণবাদের মাধ্যমে কিভাবে আমেরিকায় মানুষকে বিভক্ত করে রাখা হয়েছে। অথচ এ মানুষগুলো এ রকম বা ভিন্ন নামে হাজারও বিভক্তি দেখেও কোনো প্রতিবাদ করেনি এতদিন। তারা প্রশ্ন করেনি আয়লান কুর্দি কেন মারা গেল, তারা প্রশ্ন করেনি বিভিন্ন দেশে কেন বিনা কারণে যুদ্ধ চলছে। কেন সিরিয়ায় বিশৃঙ্খল অবস্থ। কেন আফগানিস্তান, ইরাক, লিবিয়ায় মানুষ মরছে; কেন ইয়েমেনে সৌদি আরবকে আমেরিকা সাহায্য করছে। কেন বিশ্বে অস্ত্র বিক্রিতে আমেরিকা প্রথম। এসব প্রশ্ন কখনো আমেরিকানদের করতে দেখিনি। দেশে দেশে যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়া থেকে প্রেসিডেন্টকে বিরত রাখতেও কোনো ভূমিকা লক্ষ্য করা যায়নি।

আমেরিকা শিক্ষা, সভ্যতা, সংস্কৃতি ও প্রযুক্তিতে অনেক উন্নত হলেও সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের আড়ালে এক শ্রেণির দুষ্ট বর্ণবাদ দীর্ঘকাল ধরে তাদের অন্তরে জঘন্য ধরনের বর্ণবৈষম্য ও প্রতিহিংসা লালন করে আসছে। গত বছরের শেষদিকে ইরান-আমেরিকা উত্তেজনা যুদ্ধের কাছাকাছি পৌঁছে যায়। আমেরিকা ইরানের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ নেতা ও আল কুদস ফোর্সের প্রধান কাসেম সোলাইমানিকে নির্মমভাবে ড্রোন হামলা করে হত্যা করে। ইরানও তার জবাব দেয় বাগদাদে অবস্থিত মার্কিন ঘাঁটিতে হামলা করে। কিন্তু কথা হলো দুটি দেশই আরেক দেশের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন করে একে অন্যের ওপর হামলা করেছে। যে ধরনের ঘটনা আমেরিকা সব সময় করে এবং মনে করে এটা তাদের জন্য কোনো অন্যায় নয় বরং তাদের অধিকারে পড়ে। যে কোনো সময় যে কোনো দেশের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন, অন্য দেশের ভূখ-ে ঢুকে হামলা করা, কাউকে ধরে নিয়ে যাওয়া- সবই তারা করছে প্রশ্নাতীতভাবে। কোন দেশে কোন সরকার ক্ষমতায় থাকবে; কোন দেশে গণতন্ত্র আছে, কোন দেশে নাই তারাই ঠিক করে। আর তাদের এসব অসভ্যতার দিকে কাউকে আঙুল তুলতেও দেখা যায় না। পাশ্চাত্য সভ্য সমাজের অসভ্যতা আজ মানুষের সামনে নগ্নভাবে ফুটে উঠেছে।

লেখক : গণমাধ্যম কর্মী
ibrahim242599@gmail.com