ড. প্রণবানন্দ চক্রবর্ত্তী 

মঞ্চ ছিল যাঁর সবচেয়ে শান্তির জায়গা

আরেক নক্ষত্রের পতন ঘটলো। হারিয়ে গেলেন একুশে পদকপ্রাপ্ত অভিনেতা, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শব্দসৈনিক, প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব আলী যাকের। টেলিভিশন ও মঞ্চ নাটকে সমান জনপ্রিয়। বাংলাদেশের বৃহত্তম বিজ্ঞাপনী সংস্থা এশিয়াটিক থ্রিসিক্সটির (3Sixty) কর্ণধার ছিলেন।

তিনি অর্জন করেন একুশে পদক, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি পুরস্কার, বঙ্গবন্ধু পুরস্কার, মুনীর চৌধুরী পদক, নরেন বিশ্বাস পদক, দ্য ডেইলি স্টার-স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড সেলিব্রিটিং লাইফ, মেরিল-প্রথম আলো আজীবন সম্মাননা পুরস্কারসহ অগণিত সম্মাননা। কবর, বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ, বাকী ইতিহাস, বিদগ্ধ রমণী কুল, তৈল সংকট, এই নিষিদ্ধ পল্লীতে, দেওয়ান গাজীর কিস্‌সা, সৎ মানুষের খোঁজে, অচলায়তন, কোপেনিকের ক্যাপ্টেন, ম্যাকবেথ, টেম্পেস্ট, নূরলদীনের সারাজীবন, কবর দিয়ে দাও, গ্যালিলিও, কাঁঠাল বাগান (চেরি অরচার্ড) মঞ্চ নাটকগুলোর কথা মনে পড়লে তাঁর বহুমাত্রিক অবয়বের কথা আমাদের মানসপটে ভেসে ওঠে ।

টেলিভিশন ধারাবাহিক বহুব্রীহি, আজ রবিবার; চলচ্চিত্র আগামী, নদীর নাম মধুমতী, লালসালু , রাবেয়া ; একক নাটক একদিন হঠাৎ, নীতু তোমাকে ভালোবাসি, পাথর সময়, অচিনবৃক্ষ, আইসক্রিম, পান্ডুলিপি, গণি মিয়ার পাথর আজও মানুষের মনের গভীরে স্থান করে আছে ।

দীর্ঘদিন ধরে ক্যান্সারে আক্রান্ত থাকলেও আরও কিছুদিন হয়তো এই মহান মানুষটির কর্ম তাঁর সহকর্মীদের উজ্জীবিত করত। কিন্তু কী এক ভয়ঙ্কর ব্যাধি! কোভিড-১৯ তা হতে দিল না । আমাদের সবার প্রিয়, শ্রদ্ধেয় নাট্যাঙ্গনের গম্ভীর অথচ শিশুসুলভ, সদা হাস্যোজ্জ্বল ‘ছোটলো ভাই’ ২০২০ খ্রিস্টাব্দের ২৭ নভেম্বর সকালে ঢাকার ইউনাইটেড হাসপাতালে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন । ঢাকার মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে ‘গার্ড অব অনার’ দেওয়ার সময় অশ্রুভরা চোখে বন্ধু-স্বজন-সহকর্মীরাও জানিয়েছেন শেষবিদায়। কি কঠিন বাস্তবতা! এই মানুষটি নেই, হারিয়ে গেলেন চিরতরে! বনানী কবরস্থানে তাঁকে সমাহিত করা হয়। তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৬ বছর।

আলী যাকের ১৯৪৪ সালের ৬ নভেম্বর তৎকালীন চট্টগ্রাম জেলার ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহকুমার (বর্তমানে জেলা) রতনপুর ইউনিয়নে জন্মগ্রহণ করেন। মাহমুদ তাহের ও রেজিয়া তাহেরের চার সন্তানের মধ্যে যাকের ছিলেন তৃতীয়। পিতা মরহুম মোহাম্মদ তাহের জেলা প্রশাসক ছিলেন। তার বাবার বদলিযোগ্য কাজের ফলস্বরূপ তিনি তার শৈশব কাটিয়েছেন চট্টগ্রাম, খুলনা, মাদারীপুর, কুষ্টিয়ায়। ১৯৫৩ সালে তিনি ঢাকায় আসেন।

আলী যাকের ১৯৬০ সালে সেন্ট গ্রেগরিজ উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন। পরে ঢাকার নটর ডেম কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা সম্পন্ন করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন এবং সেখান থেকে সমাজবিজ্ঞানে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। এ সময় তিনি ছাত্র ইউনিয়নের সাথে যুক্ত হন।

১৯৬৬ সালে যুক্তরাজ্যভিত্তিক বিজ্ঞাপন কোম্পানি ডব্লিউ এস ক্রাউফর্ডস্ লিমিটেডের সাথে করাচিতে কর্মজীবন শুরু করেন। ১৯৬৮ সালে ইস্ট এশিয়াটিক অ্যাডভার্টাইজিং লিমিটেডে যোগ দেন।

বর্তমানে দেশের বৃহত্তম যোগাযোগ কোম্পানি এশিয়াটিক ৩৬০-এর গ্রুপের চেয়ারম্যান ছিলেন। এশিয়াটিক মার্কেটিং কমিউনিকেশনস লিমিটেড দেশের প্রায় ২০টি (বিশ) নেতৃস্থানীয় কোম্পানি/প্রতিষ্ঠানের জন্য মার্কেটিং কমিউনিকেশন পরিচালনা করে। সরাসরি ১০০টিরও বেশি বিজ্ঞাপন চলচ্চিত্র এবং ভিডিও নির্মাণের তত্ত্বাবধান করা। এছাড়াও বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ বিপণন ও সামাজিক গবেষণা কোম্পানি এমআরসি-মোড লিমিটেডের চেয়ারম্যান, এশিয়াটিক ইভেন্টস মার্কেটিং লিমিটেড, দেশের অন্যতম বৃহৎ ইভেন্ট সক্রিয়করণ কোম্পানি; এশিয়াটিক মাইন্ডশেয়ার, এশিয়াটিক ম্যাক্সাস এবং এশিয়াটিক মিডিয়া এজ, তিনটি নেতৃস্থানীয় মিডিয়া পরিকল্পনা- প্রচার এবং পর্যবেক্ষণ কোম্পানি দেশের মিডিয়া ব্যবসার প্রায় অধিকাংশ পরিচালনা, নয়নতারা যোগাযোগ- সিসিমপুর নির্মাতা- সিসিম স্ট্রিটের বাংলা রূপান্তর।

১৯৭২ সালের আলী যাকের আরণ্যক নাট্যদলের হয়ে মামুনুর রশীদের নির্দেশনায় মুনীর চৌধুরীর ‘কবর’ নাটকটিতে প্রথম অভিনয় করেন, যার প্রথম প্রদর্শনী হয়েছিল ইঞ্জিনিয়ারিং ইন্সটিটিউশনে। ১৯৭২ সালের জুন মাসের দিকে আতাউর রহমান ও জিয়া হায়দারের আহ্বানে নাগরিক নাট্যসম্প্রদায়ে যোগ দেন। ওই দলে তিনি আতাউর রহমানের নির্দেশনায় বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ নাটকে প্রথম অভিনয় করেন, যার প্রথম মঞ্চায়ন হয়েছিল ওয়াপদা মিলনায়তনে। ১৯৭৩ সালে নাগরিক নাট্যসম্প্রদায়ে তিনি প্রথম নির্দেশনা দেন বাদল সরকারের বাকি ইতিহাস নাটকে, যা ছিল বাংলাদেশে প্রথম দর্শনীর বিনিময়ে নাট্য প্রদর্শনীর যাত্রা।

বের্টোল্ড ব্রেখটের দ্য লাইফ অব গ্যালিলিও অবলম্বনে অনুবাদ নাটকে নামচরিত্র “গ্যালিলিও” হিসেবে অভিনয়ের জন্য আলী যাকেরকে “বাংলার গ্যালিলিও” হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।

নাগরিক নাট্যসম্প্রদায়ের জন্য বিশ্বখ্যাত বিদেশী নাটকের বাংলা রূপান্তর আর নাটক নির্দেশনা এসব কাজে আলী যাকের ব্যস্ত ছিলেন। ১৯৭৩ সালে ঐ দলে যোগ দেন সারা যাকের যাকে শুরুতে চোখেই পড়েনি আলী যাকেরের। একটি নাটকের প্রদর্শনীর আগের দিন একজন অভিনেত্রী হঠাৎ অসুস্থ হয়ে গেলে সারা যাকেরকে দেওয়া হয় চরিত্রটিতে অভিনয় করতে। আলী যাকেরের ওপর দায়িত্ব পড়ে চরিত্রটার জন্য তাকে তৈরি করার এবং খুব দ্রুত চরিত্রটির সাথে নিজেকে মানিয়ে নেন সারা যাকের। এই প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে যান আলী যাকের। ১৯৭৭ সালের এই ঘটনার রেশ ধরেই আলী যাকের আর সারা যাকেরের বিয়ে হয়। এই দম্পতির দুই সন্তান, পুত্র অভিনেতা ইরেশ যাকের ও কন্যা শ্রিয়া সর্বজয়া। ইরেশ ও শ্রিয়া দুজনই এশিয়াটিক মার্কেটিং যোগাযোগ লিমিটেডে অফিসিয়াল চিফ এবং ব্র্যান্ডের চিঠিপত্রের সুপারভাইজার হিসাবে আলাদাভাবে কাজ করছেন।

সারাটিদিন সারাটি জীবন ব্যস্ত এ মহান মানুষটির সবকিছু লেখা এ পরিসরে সম্ভব হলো না বলে বাকীটুকু জানার ও লেখার তৃষ্ণা থেকেই গেল। শিশুর মতো মনটি যাঁর, সে-ইতো পারে এতসব সৃজনশীল কাজ করতে। শ্রদ্ধা-শ্রদ্ধা আপনাকে, শ্রদ্ধা আপনার কর্মকে। আমার আত্মার আত্মীয়ের চেয়েও যেন তাঁর জন্য বুকে চাপধরা ব্যথা, বোঝানো যাবে না কাউকে।

শান্তিতে থাকুন, আমরাও আসছি, তখন দেবেন না ফিরিয়ে, বাকী আছে — —

ড. প্রণবানন্দ চক্রবর্ত্তী : নির্দেশক, অভিনেতা, সংগঠক, লোক নাট্যদল, বনানী;
ডেপুটি রেজিস্ট্রার, উত্তরা ইউনিভার্সিটি।

সূত্র : আলী যাকের – উইকিপিডিয়া (wikipedia.org) Published Artilces (alyzaker.love)