গোফরান পলাশ, পটুয়াখালী: পটুয়াখালীর গলাচিপার বাসন্তী রানী দাস ৪৯ বছর কাটিয়ে দিয়েছেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর দেয়া একখানা চিঠি আর স্বামীর শেষ
স্মৃতি চিহ্ন এক জোড়া জুতাকে অবলম্বন করে। এ দু’টি স্মৃতির মাঝে সে নিহত স্বামী আর স্বাধীনতার প্রিয় মুখ দেখতে পান। খূঁজে পান বঙ্গবন্ধুর হাতের স্পর্শ। এ দীর্ঘ সময়ে দুঃখ-কষ্টে জীবন কাটালেও স্মৃতিচিহ্ন দুটি হাতছাড়া করেননি। জীবনের শেষ বেলায় খুব একটা বড় কিছুর প্রত্যাশা নেই বাসন্তী
রানীর। এ দু’টি প্রিয় স্মৃতি নিয়ে কাটিয়ে দিতে চান জীবনের বাকিটা সময়।

বাসন্তী রানী দাস (৭০) এর বাড়ি গলাচিপা উপজেলার চিকনিকান্দী বন্দরে। স্বামী শান্তি রঞ্জন দাস ছিলেন স্বাধীনতা পূর্ববর্তী সময়ে এলাকার ধনাঢ্য ব্যবসায়ী। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধাকে নিজ হাতে রান্না করে ভাত খাইয়েছেন এবং টাকা-পয়সা দিয়ে সহায়তা করেছেন। নৌকা দিয়ে রাতের আঁধারে নদী পাড় করে দিয়েছেন। আর এসবই এক সময় তার জন্য কাল হয়ে দাড়ায়।

মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তার অপরাধে পাক হানাদার আর রাজাকার-আলবদররা বিয়ের মাত্র ১২ বছরের মধ্যে হত্যা করে শান্তি রঞ্জন দাসকে। বাসন্তী রানী দাস জানান, একাত্তরের ৮ মে শুক্রবার সকালে পাক হানাদার বাহিনী স্থানীয় রাজাকার-আলবদরদের সহায়তায় হঠাৎ করে চিকনিকান্দীসহ আশেপাশের গ্রামের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে গণহত্যা, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট চালায়।

পাঁচ সন্তানের এই জননী তখন অন্তসত্ত্বা। এ অবস্থায় পাড়ডাকুয়া গ্রামের একটি বাড়িতে আশ্রয় নেন তারা। বিকালে রাজাকাররা শান্তি রঞ্জন দাসকে ধরে নিয়ে যায় পাক বাহিনীর কাছে। পাকিস্তানি সেনাদের সামনে তাকে গাছের সঙ্গে পিছ মোরা করে বেঁধে রাখা হয়। রাজাকাররা পরবর্তী তিন দিন ধরে শান্তি রঞ্জন দাসের ওপর চালায় অবর্ণনীয় নির্যাতন। তাকে চাকু দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। তার শরীরের মোট ৮৭টি স্থানে পোচ দেয়া হয়েছিল।

নির্যাতনে মৃত্যুর পর রাজাকাররা তার স্বামীর লাশ নদীতে ফেলে দেয়। তার সব কিছু লুটপাট করে দোকান ও বাড়িতে খোলা হয় শান্তি কমিটির অফিস। পনের দিন লাশটি নদীর জলে ভেসে বেড়িয়েছিল। ওদের ভয়ে লাশ কেউ সৎকার করতে সাহস পায়নি।

মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে সর্বস্বহারা পরিবারের মতো এ পরিবারটিও নিঃস্ব। আজও মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি বাসন্তী রানী। সন্তানদের তেমন লেখাপড়া শেখাতে
পারেননি। কোনোমতে একখানা দোচালা ঘর তুলে বাস করেন সরকারি খাস জমিতে। সরকারি এই জমিটুকুর বন্দোবস্ত পাওয়ার জন্য সরকারি অফিসে বহুবার আবেদন নিবেদন করেছেন। কিন্তু কর্মচারীদের চাহিদা মেটাতে পারেননি বলে জমি বন্দোবস্ত পাননি। সর্বশেষ গত সংসদ নির্বাচনের সময়ে শহীদ জায়া বাসস্তী
রানী দাসের সঙ্গে দেখা করেছিলেন একাত্তরে পটুয়াখালী অঞ্চলের মুক্তিবাহিনী প্রধান মো. নূরুল হুদা। অসহায় এ পরিবারটির আর্তি শুনে তিনি আশ্বাস দিয়েছিলেন বিষয়টি দেখার। কিন্তু আজও সুরাহা হয়নি বাসন্তী রানীর থাকার জায়গাটুকুর।

বাসন্তী রানীর শুধু এটুকুই শান্তনা স্বাধীনতার কয়েক মাস পর বঙ্গবন্ধুর স্বাক্ষর করা একখানা চিঠি ও দুই হাজার টাকা পেয়েছিলেন। যে চিঠিতে বঙ্গবন্ধু গভীর শ্রদ্ধার সাথে তার স্বামীর আত্মত্যাগে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন।