অনলাইন ডেস্ক : যুদ্ধাপরাধ মামলার এক আসামির সঙ্গে গোপন বৈঠক ও মামলার স্বার্থবিরোধী ভূমিকার অভিযোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর তুরিন আফরোজকে ট্রাইব্যুনালের সব মামলা পরিচালনার দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।

তার কাছে থাকা যুদ্ধাপরাধ মামলার সব নথিও প্রসিকিউশনে জমা দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপু।

একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় গত ২৪ এপ্রিল গ্রেপ্তার পাসপোর্ট অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক মুহাম্মদ ওয়াহিদুল হকের সঙ্গে তুরিন আফরোজ গোপনে বৈঠক ও টেলিফোনে আলাপ করেছেন বলে অভিযোগ প্রসিকিউশনের। এখন কারাবন্দি ওয়াহিদুল হক (৬৯) জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থারও (এনএসআই) সাবেক মহাপরিচালক।

একাত্তরে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সদস্য হিসেবে রংপুর ক্যান্টনমেন্টে চালানো গণহত্যায় সম্পৃক্ততার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। তুরিন আফরোজ এ মামলা পরিচালনার দায়িত্ব পাওয়ার পর গত বছর নভেম্বরে ওয়াহিদুল হককে ফোন করে কথা বলার পর পরিচয় গোপন করে ঢাকার একটি হোটেলে তার সঙ্গে দেখা করেন বলে অভিযোগ।

তাদের কথোপকথনের রেকর্ড ও বৈঠকের অডিওরেকর্ডসহ যাবতীয় তথ্য-প্রমাণ এরইমধ্যে আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে বলে একজন প্রসিকিউটর জানিয়েছেন। এ বিষয়ে সরাসরি কোনো জবাব দেননি তুরিন আফরোজ। এক ফেইসবুক পোস্টে নিজেকে নির্দোষ দাবি করলেও ওই গোপন বৈঠকের কথা অস্বীকার করেননি তিনি।

যুদ্ধাপরাধের বিচারে ২০১০ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠনের তিন বছরের মাথায় প্রসিকিউটর হিসেবে নিয়োগ পেয়েছিলেন তুরিন আফরোজ। জামায়াতে ইসলামীর আমির গোলাম আযমের মামলাসহ গুরুত্বপূর্ণ বেশ কয়েকটি মামলা পরিচালনায় ভূমিকা রাখেন তিনি।

সব মামলা থেকে তাকে অব্যাহতির কথা জানিয়ে গত মঙ্গলবার তুরিন আফরোজকে পাঠানো ওই চিঠিতে বলা হয়েছে, “আইসিটি বিডি মিস কেস নং ১/২০১৮ এর প্রসিকিউটর হিসেবে আপনার দায়িত্ব পালন থেকে বিরত ও প্রত্যাহারের ধারাবাহিকতায় আজ (৮ মে) আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সকল মামলা থেকে বিরত ও প্রত্যাহার এর আদেশসহ আপনার নিকট ট্রাইব্যুনালের বিভিন্ন মামলার সকল ডকুমেন্টস প্রসিকিউটর অফিসে জমা দেওয়ার আদেশ দেওয়া হল।”

চিঠিতে তার বিরুদ্ধে অভিযোগের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দিয়ে বলা হয়েছে, “গত বছরের ১৮ নভেম্বর আসামি মেজর (অব.) মোহাম্মদ ওয়াহিদুল হকের সাথে টেলিফোনে আলাপের এবং ১৯ নভেম্বর গুলশানের অলিভ রেস্টুরেন্টে আপনার সাথে আপনার সহযোগী ফারাবিসহ মেজর (অব.) মোহাম্মদ ওয়াহিদুল হক, তার স্ত্রী ও অন্য একজন মুরুব্বির আলাপের মোবাইলে ধারণকৃত প্রায় পৌনে তিন ঘণ্টার রেকর্ড তদন্ত সংস্থার মাধ্যমে প্রসিকিউশন অফিসে প্রাপ্তির আলোকে প্রসিকিউশন তথা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচার প্রক্রিয়ার ভাবমূর্তি রক্ষা ও স্বচ্ছতার জন্য জনস্বার্থে এ আদেশ দেয়া হল।”

গত বছরের ১১ নভেম্বর এ মামলার দায়িত্ব পেয়েছিলেন তুরিন আফরোজ।

তাকে অব্যাহতির চিঠি পাঠানোর আগের দিন প্রসিকিউশন অফিসের এক আদেশে এই মামলা থেকে তুরিন আফরোজ ও তাপস কান্তি বলকে প্রত্যাহার করে প্রসিকিউটর জেয়াদ আল মালুম, মোখলেসুর রহমান বাদল, সুলতান মাহমুদ, মো. সাহিদুর রহমান, মো. জাহিদ ইমাম ও রেজিয়া সুলতানা বেগমকে দায়িত্ব দেওয়া হয়।

বৃহস্পতিবার এই মামলার পরবর্তী শুনানি অর্থাৎ তদন্তের অগ্রগতি প্রতিবেদন দেওয়ার দিন রয়েছে।

বিষয়টি নিয়ে বুধবার খবর প্রকাশ করে ‘আমাদের সময় ডটকম’ নামে একটি অনলাইন পোর্টাল। এরপর এ বিষয়ে নিজের বক্তব্য তুলে ধরে ফেইসবুকে একটি পোস্ট দেন তুরিন আফরোজ।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তুরিন আফরোজ বলেন, ফেইসবুকে তিনি এ বিষয়ে নিজের অবস্থান তুলে ধরে বক্তব্য দিয়েছেন। সেটিই আপাতত তার বক্তব্য।
ফেইসবুকে তিনি লিখেছেন, “আমাকে নিয়ে একটি অতি উৎসাহী দৈনিক পত্রিকাতে একটি বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রকাশ করা হলে সোশ্যাল মিডিয়াতে তা ভাইরাল করে আমাকে নিয়ে নানা কুৎসা রটনা করা হচ্ছে। এটাও বলা হচ্ছে যে আমাকে প্রসিকিউটর পদ থেকে বরখাস্ত করা হয়েছে।

এই বিষয়ে আমার সুস্পষ্ট বক্তব্য:

১। আমি এখনও আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর পদে বহাল আছি। আমাকে কেউ বরখাস্ত করেনি।

২। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনে ৮(২) ধারা অনুযায়ী ট্রাইব্যুনালের একজন প্রসিকিউটারের একজন তদন্ত কর্মকর্তা হিসেব কাজ করার এখতিয়ার রয়েছে। সুতরাং যে কোন মামলাতে তদন্ত করার এখতিয়ার আমার আছে। আর তদন্ত করতে গেলে নানা রকম কৌশল অবলম্বন করতে হয়। সুতরাং আমি তদন্তের স্বার্থে যে কোন প্রয়োজনীয় কৌশল গ্রহন করতে পারি।

৩। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে আমি এই পর্যন্ত প্রসিকিউটর হিসেবে যা কিছুই করেছি তা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ অবহিত ছিলেন।

৪। আমাকে নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে যে অভিযোগ তোলা হয়েছে তা সত্য নয়। যেহেতু বিষয়টি এখন ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ তদন্ত করে দেখছেন তাই সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে এই মুহূর্তে বিষয়টি নিয়ে আমি কোন মন্তব্য করতে চাই না।

“তদন্ত শেষ হলে আমি আমার বক্তব্য সর্ব সম্মুখে প্রকাশ করবো। আশা করি সেই পর্যন্ত আমার শুভাকাঙ্ক্ষী ও সমালোচকগণ ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করবেন।”

তার কর্মকাণ্ড সম্পর্কে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ অবহিত ছিলেন বলে তুরিন আফরোজ দাবি করলেও ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার জ্যেষ্ঠ সমন্বয়ক সানাউল হক বলেন, এ বিষয়ে কিছু জানতেন না তারা।

প্রসিকিউটর জেয়াদ আল মালুমও বলেছেন, বিষয়টি নিয়ে প্রসিকিউশনের কোনো ধারণাই ছিল না।

তদন্তাধীন মামলার আসামির সঙ্গে রাষ্ট্রপক্ষের কোনো আইনজীবীর গোপনে দেখা বা সাক্ষাৎ নৈতিকতাবিরোধী মন্তব্য করে সানাউল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “প্রথমত কথা হচ্ছে উনি এ মামলা তদন্ত করেন না। তদন্ত করেন তদন্ত কর্মকর্তা মতিউর রহমান। ফেইসবুকে দেখলাম উনি (তুরিন আফরোজ) গোপনে তদন্ত করতে চেয়েছিলেন আমাদের জানিয়েছেন। কিন্তু এ রকম কোনো নিয়ম নেই আমাদের তদন্তে।

“আর তদন্ত যদি উনাকে করতে হয় তাহলে তো আমাদের জানিয়ে তা করতে হবে। কিন্তু তিনি তা করেননি।”

ওয়াহিদুল হকের সঙ্গে তুরিন আফরোজের কথপোকথনের অডিও রেকর্ড তদন্ত সংস্থা কীভাবে পেয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “আসামিকে গ্রেপ্তার করার সময় গুলশান থানার ওসি তার মোবাইল ফোন জব্দ করেছিল। ওই মোবাইলে কথোপকথনের কিছু রেকর্ড ছিল। কথোপকথনের দুটি রেকর্ড আছে সেখানে। একটি কথোপকথন হয়েছে টেলিফোনে। এটা তিন-চার মিনিট হবে। এই কথপোকথনে তুরিন আফরোজ আসামি মোহাম্মদ ওয়াহিদুল হককে দাওয়াত দিয়েছেন দেখা করার অনুমতি চেয়ে। তুরিনই ফোনটা দিয়েছিল।

“তার পরেরটা দুই ঘণ্টা ৪৫ মিনিটের। এই কথপোকথনে মামলা সংক্রান্ত অনেক কথা রয়েছে এবং মামলার ডকুমেন্ট হস্তান্তরের কথোপকথন রয়েছে। ওসি এটা পাওয়ার পর সে মনে করল যে, আমাদের জানানো দরকার। আমরা এটা হাতে পাওয়ার পর প্রসিকিউশনকে দিয়েছি।”
কথোপকথনে কী আছে- জানতে চাইলে সানাউল হক বলেন, “অন্য একজনকে স্বামী সাজিয়ে বোরকা পরে তিনি আসামির সঙ্গে দেখা করতে গেছেন বলে অডিও রেকর্ডে আছে। ফারাবী নামের একজনকে তিনি স্বামী হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। এ রকম কথা আছে রেকর্ডে। এছাড়া এ মামলার বিরুদ্ধে আলাপ-আলোচনা হয়েছে। বলা হয়েছে এ মামলাটি টোটালি মোটিভেটেড। এমন কথাও বলা হয়েছে। আমাদের কাছে মনে হয়েছে এটা নৈতিকভাবে ঠিক না।”

ওয়াহিদুল হকের সঙ্গে তুরিন আফরোজের গোপনে বৈঠকের যাবতীয় তথ্য-উপাত্ত বুধবার সকালে আইন মন্ত্রণালয় পাঠানো হয়েছে বলে প্রসিকিউটর জেয়াদ আল মালুম জানিয়েছেন।

ফেইসবুকে দেওয়া তুরিন আফরোজের বক্তব্যের বিষয়ে জেয়াদ আল মালুম  বলেন, “প্রসিকিউশনের কাছে যেসব তথ্য-উপাত্ত এসেছে তাতে প্রসিকিউটর হিসেবে তুরিন আফরোজের বিরুদ্ধে পেশাগত অসদাচরণের প্রমাণ মেলে।

“কারণ ট্রাইব্যুনালের কোনো মামলা তদন্তে তদন্ত সংস্থা তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগ দেয়। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনে ৮ (২) ধারা অনুযায়ী একজন প্রসিকিউটর কেবল তদন্তকারী কর্মকর্তাকে সহযোগিতা করতে পারেন। মামলার তদন্তের ক্ষেত্রে যদি কোনো কৌশল অবলম্বন করতেই হয় সেটিও চিফ প্রসিকিউটরকে না জানিয়ে করা যাবে না। কিন্তু প্রসিকিউশন এ ব্যপারে কিছুই জানত না।”

অভিযোগ প্রমাণ হলে তুরিন আফরোজের বিরুদ্ধে কী ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হতে পারে জানতে চাইলে মালুম বলেন, “এটা সম্পূর্ণ আইন মন্ত্রণালয়ের এখতিয়ার। প্রসিকিউটর নিয়োগ দেয় সরকার। অভিযোগ প্রমাণ হলে প্রসিকিউশন থেকে তাকে বরখাস্ত করা হতে পারে। এছাড়া অভিযোগ গুরুতর হলে বার কাউন্সিলের সনদও বাতিল হতে পারে। আবার ফৌজদারি মামলাও হতে পারে। তবে তা ঠিক করবে আইন মন্তওণালয়।”

এ বিষয়ে বুধবার দুপুরে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, “এটা সত্যি হলে মন্ত্রণালয় অবশ্যই পদক্ষেপ নেবে। আমিতো আর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে যাই না বা তাদের মামলাও পরিচালনা করি না। কাজেই এ বিষয়ে আমার পক্ষে বলা সম্ভব না। এটি মন্ত্রণালয় দেখবে।”

বিষয়টি নিয়ে মন্ত্রণালয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের মুখে পড়েছিলেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হকও। তিনি বলেন, তুরিন আফরোজের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে অভিযোগ সংক্রান্ত নথি দেখে।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম