জিকা একটি ভাইরাসের নাম। এ ভাইরাসের কারণে সবারই কিছু না কিছু ক্ষতি হলেও সবচেয়ে মারাত্মক জটিলতা হয় গর্ভস্থ শিশুর। এ রোগে গর্ভস্থ শিশুর ‘মাইক্রোসেফালি’ হয় অর্থাৎ মাথা বা মগজ ছোট হয়। ফলে মস্তিষ্কের সঠিক বিকাশ হয় না।

এসব বাচ্চার হাঁটতে বসতে সমস্যা হতে পারে। তাছাড়া কথা বলা, কানে শোনা, চোখে দেখাসহ বুদ্ধির ঘাটতি হবে। যাকে ডাক্তারি ভাষায় সেরিব্রাল পালসি বা সিপি আর সাধারণ মানুষ বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী বলে। এছাড়া বড়দের শরীর অবশ হয়ে যাওয়া বা জিবিএস রোগ হতে পারে।

নটিংহ্যাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, ভাইরাস বিশেষজ্ঞ জনাথন বেল জানান, জিকা ভাইরাসকে প্রথম শনাক্ত করা হয়েছিল ১৯৪০ থেকে ১৯৫০ সালের মধ্যে আফ্রিকার উগান্ডা-সহ বিভিন্ন অঞ্চলে। প্রথম দিকে জিকা ভাইরাসকে মারাত্মক কোনও রোগ বলে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি।

অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক ট্রুডি ল্যাং জিকা ভাইরাসটি নিয়ে গবেষণা করছেন। ট্রপিক্যাল ডিজিজ নিয়ে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে পরীক্ষা নিরীক্ষা চালাচ্ছেন তিনি।

তিনি বলেন, জিকা ভাইরাসে যে ধরণের সংক্রমণের ঘটনা ঘটছে সেগুলি নিয়ে কেউ খুব একটা গবেষণা করেনি। এই ভাইরাস প্রতিরোধের জন্যে টীকা আবিষ্কারের কথাও কেউ ভাবেনি। কিন্তু এখন এই ভাইরাসে যত সংখ্যক মানুষ আক্রান্ত হচ্ছেন এবং মাইক্রোকেফালি সমস্যা নিয়ে এতো বেশি শিশুর জন্ম হয়েছে যে, প্রশ্নাতীত ভাবেই এ নিয়ে উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে।

জিকা ভাইরাস কী?

জিকা ভাইরাস অনেকটা ডেঙ্গির মতো হলেও, গর্ভস্থ শিশুর ক্ষেত্রে এই ভাইরাস মারাত্মক ক্ষতিকর। ডেঙ্গির মতোই জিকা ভাইরাসে আক্রান্ত হলে প্রথমে জ্বর আসে। গায়ে র্যাশ বের হয়। কনজাঙ্কটিভাইটিস হয়। পেশী ও গ্রন্থিতে ব্যথা শুরু হয় ও মাথাব্যথা হতে থাকে।

কীভাবে ভাইরাসটি ছড়ায়?

এডিস মশার মাধ্যমে দ্রুত এ ভাইরাসটি ছড়ায়। জিকা ভাইরাসের সংক্রমণ ঘটেছে, এমন কোনও রোগীকে এডিস মশা কামড়ানোর মধ্য দিয়ে এর স্থানান্তর হয়। পরে ওই মশাটি অন্য ব্যক্তিদের কামড়ালে তা ছড়াতে থাকে। এই ভাবেই একজন আক্রান্তের থেকে আরেক জনের শরীরে ভাইরাসটি ছড়াতে থাকে।

ভাইরাসটি শিশুর মস্তিষ্কের ক্ষতি করে কীভাবে?

গর্ভবতী নারীরা এ ভাইরাসে আক্রান্ত হলে তা শিশুর মারাত্মক ক্ষতি করে এবং শিশু বিকলাঙ্গ হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এ কারণেই জিকা ভাইরাস বিশ্বের তাবড় চিকিত্সক ও গবেষকদের দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটির মূল কারণ মাইক্রোসেফালি নামে একটি নিউরোলজিক্যাল ডিসঅর্ডার ও ভাইরাসটির মধ্যে যোগসূত্র। এর কারণে সদ্যজাত শিশুদের মস্তিষ্ক স্বাভাবিক আকারের চেয়ে ছোট হয়। এছাড়া এর কারণে শিশুদের মধ্যে বিকাশজনিত সমস্যা দেখা দেয় এবং কখনও কখনও শিশুর মৃত্যুও হতে পারে।

বিশ্বের যেসব দেশে গর্ভবতী নারীদের জন্য এটি বিপজ্জনক?

বিশ্বের প্রায় দুই ডজন দেশে এ ভাইরাসটির আশঙ্কা রয়েছে। এসব দেশের মধ্যে ক্যারিবিয়ান, মধ্র আমেরিকান ও দক্ষিণ আমেরিকান দেশ উল্লেখযোগ্য। এল সালভাদোর, কলম্বিয়া, হন্ডুরাস, ইকুয়েডরের মত দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলি ২০১৮ সাল পর্যন্ত নারীদের সন্তানধারণের পরিকল্পনা বাতিল করতে বলেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ‘হু’।

কীভাবে বুঝবেন জিকা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন কিনা?

সংক্রামিত ব্যক্তিদের শরীরে ভাইরাসটির সামান্য উপসর্গ দেখা যায়। যেমন জ্বর, মাথাব্যথা, র্যাশ এবং চোখ গোলাপি রং ধারণ করা ইত্যাদি। প্রকৃতপক্ষে শতকরা ৮০ শতাংশ আক্রান্ত ব্যক্তি বুঝতেই পারেন না যে, তাদের শরীরে ভাইরাসটি রয়েছে। এ সব কারণে ভাইরাসটি নির্ণয় করা কঠিন আর এ সুযোগে ভাইরাসটি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। এ ক্ষেত্রে আপনার রোগটি হয়েছে বলে সন্দেহ হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।

গর্ভাবস্থার কোন পর্যায়ে জিকা ভাইরাস বেশি বিপজ্জনক?

চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, গর্ভাবস্থার প্রথম দিকে যদি জিকা ভাইরাস আক্রমণ করে তাহলে তা বেশি বিপজ্জনক। এ সময় ভাইরাসটি গর্ভস্থ শিশুর দেহে সংক্রমিত হয় এবং শিশুর বিকলাঙ্গ হওয়ার আশঙ্কা প্রবল হয়।

জিকা ভাইরাস আক্রান্ত হলে শিশুরও পরীক্ষা করতে হবে কি?

জিকা ভাইরাস আক্রান্ত হলে শিশুরও পরীক্ষা করতে হতে পারে। তবে এ ক্ষেত্রে মায়ের কোনও ভাবে জিকা ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে, তা হলেই শুধু শিশুর পরীক্ষা প্রয়োজন হতে পারে।

জিকা ভাইরাসের কোনো চিকিৎসা আছে কি?

জিকা ভাইরাসে আক্রান্ত হলে এখনও পর্যন্ত তেমন কোনও সুনির্দিষ্ট চিকিৎসা নেই। তবে এ রোগটি সাধারণ মানুষের তেমন ক্ষতি করে না। কয়েক দিন বিশ্রাম করলেই তা সেরে যায়। শুধু গর্ভবতী নারীরা আক্রান্ত হলেই গর্ভস্থ শিশুর মারাত্মক ক্ষতির আশঙ্কা থাকে। এছাড়া জিকা ভাইরাসের কোনো টীকা এখনো আবিষ্কৃত হয়নি। তবে টীকা তৈরির চেষ্টা করছেন গবেষকরা।