গনেশ চন্দ্র হাওলাদার :

বিশ্বব্যাপী কোভিড-১৯ মহামারি রোধে চলছে ইতিহাসের সবচেয়ে বড় টিকাদান কর্মসূচি। টিকা পাওয়ার জন্য সারা বিশ^ যেখানে অঘোষিত ঠান্ডাযুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে, বাংলাদেশের সামগ্রিক অবস্থা বিবেচনায় নিলে ঠিক তার বিপরীত চিত্র পরিলক্ষিত হয়। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলো আদৌ ভ্যাকসিন পাবে কি না, সে দুশ্চিন্তা ছিল। তবে সরকারের সময়োপযোগী কর্মতৎপরতায় আমরা এরই মধ্যে ভ্যাকসিন পেয়ে গেছি। অনেক বাঘা বাঘা দেশের তুলনায় ত্বরিতগতিতে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক টিকা ক্রয় চুক্তি সম্পন্ন এবং চুক্তি মোতাবেক সময়মতো দেশে টিকার প্রথম ধাপ আসার পর যথারীতি জনগণকে টিকাদান শুরু করে। বিশেষ একটি মহল তাদের সর্বশক্তি দিয়ে চেষ্টা চালিয়ে গেছে যাতে মানুষ টিকা গ্রহণ না করে।বাংলাদেশ টিকাবান্ধব দেশ। মা-বাবা তাদের ৩৫-৪৫ দিনের অবুঝ সন্তানকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে টিকাদান কেন্দ্রে নিয়ে এসে টিকা দিয়ে নিয়ে যান। টিকার সুফলও মানুষ পাচ্ছেন। এ রকম প্রেক্ষাপটে ১৮ বছরের বেশি বয়সিদের কোভিড-১৯ টিকা নিয়ে বিরূপ প্রচার বা অপপ্রচার হবে কিংবা কোনো মহল গুজব ছড়াবে এমন আশঙ্কা বা চিন্তা সরকার কিংবা আপাময় সাধারণ মানুষের মধ্যে ছিল না। কেননা, রাজনীতিতে যতই মতভেদ থাকুক জনগণের কল্যাণের জন্যই তো রাজনীতি। আর যেখানে মানুষের জীবন-মরণের প্রশ্ন; সেখানে সব রাজনৈতিক মতাদর্শের মানুষ সম্মিলিত প্রয়াসের মাধ্যমে করোনা মহামারি মোকাবিলা করবে; সেটাই তো স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল, সরকার যখন থেকে টিকা আনার জন্য নানা মাধ্যমে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, তখন থেকেই একটি মহল বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক মাত্রায় নেতিবাচক গুজব ছড়ানো শুরু করেছিল। গুজবগুলো হচ্ছে ‘টিকা নেওয়ার ফলে ভারতে শত শত মানুষ মারা গেছে, চিকিৎসাকর্মীরা টিকা নেওয়ার ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন’, ‘ভ্যাকসিনের মাধ্যমে শরীরে চিপস ঢুকিয়ে দেওয়া হবে। যা দিয়ে আপনি কখন কী করছেন, সব জানা ও দেখা যাবে’, কারো কারো মুখ বাঁকা হয়ে গেছে ইত্যাদি। ভারতের উপহারের ২০ লাখ ডোজ টিকা আসার পর গুজব ছড়ানো হলো, ভারত তাদের দেশে উৎপাদিত টিকার ট্রাইল করার জন্য বাংলাদেশের মানুষকে গিনিপিক হিসেবে ব্যবহার করতে যাচ্ছে। যেহেতু টিকা ভারত থেকে আসছে, এ ক্ষেত্রে ভারতবিরোধী রাজনীতির প্রসঙ্গ সামনে আনা হচ্ছে। অথচ প্রতি বছর কয়েক লাখ মানুষ ভারতে গিয়ে চিকিৎসা নেন। যাদের অধিকাংশই ভারতে চিকিৎসা নিয়ে খুশি। কোনো দেশকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল করার নজির বিভিন্ন দেশে আছে, বাংলাদেশেও তা বেশ ভালোভাবেই আছে, এটা ভালো কী মন্দ সে বিতর্কে যাব না; কিন্তু করোনাভাইরাসের মতো ভয়াবহ একটা মৃত্যুদূতের হাত থেকে বাঁচতে এ মুহূর্তে একমাত্র যে প্রতিষেধক টিকা আবিষ্কার হয়েছে; যা কি না উন্নত বিশে^র এবং পাশর্^বর্তী দেশের মানুষের দেহে ট্রাইলের মাধ্যমে সফল প্রমাণিত হয়েছে, তা নিয়ে রাজনীতি করা কতটা শোভনীয় সেটা বোধগম্য নয়। সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে বড় কোনো ইস্যু না পেয়ে টিকার ওপর ভর করে মহল বিশেষের রাজনীতির মাঠ গরমের একটা ব্যর্থ প্রচেষ্টা আমরা প্রতক্ষ্য করেছি। এ ছাড়া টিকার ক্রয়মূল্য নিয়েও নানা রকম গুজব ছড়ানো হয়েছে। এমন একটা ধারণা জনমনে গেঁথে দেওয়ার চেষ্টা করেছিল যে, সরকার টিকার মাধ্যমে তার বিরোধী পক্ষকে মেরে ফেলা কিংবা পঙ্গু করে ফেলার প্ল্যান করেছে।

নানাবিধ গুজবের ফলে বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষের মনে টিকা গ্রহণ নিয়ে বড় ধরনের আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছিল। এ কারণেই সমাজের অতি সচেতন মানুষও প্রথম অবস্থায় টিকা নিতে সাহস করেনি। এমনকি সাংবাদিকরাও, যারা নাকি সারা পৃথিবীর ভালো-মন্দ সব সত্য খবর প্রতিনিয়ত সবাইকে জানিয়ে দেন, তারাও এসব গুজব আমলে নিয়ে টিকা নিতে আগ্রহ দেখাননি। তবে সরকারের শক্ত মনোভাব ও সময়োপযোগী কৌশলের কাছে পরাস্ত হয়ে এসব গুজববাজ মহল শেষ পর্যন্ত কোভিড-১৯-এর টিকা জনসাধারণকে অমূলক ভয়ের মধ্যে সাত দিনের বেশি রাখতে পারেনি। মন্ত্রী, এমপি, সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ কর্মকর্তাসহ সাধারণ মানুষ এখন প্রতিদিন উৎসবের আমেজে টিকা নিচ্ছেন এবং সেসব দৃশ্য সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট করে অন্যদের টিকা নেওয়ার জন্য আহ্বান জানাচ্ছেন। পরিস্থিতি এমনভাবে ইউটার্ন নিচ্ছে যে, ভবিষ্যতে টিকা নিতে চান না এমন মানুষ বাইনুকুলার দিয়েও খুঁজে পাওয়া যাবে না। বরং টিকা পাওয়ার জন্য নানামুখী লবিং-গ্রুপিং শুরু হয়ে যাবে। কেননা দেশের ১৬ কোটি মানুষের জন্য ৩২ কোটি ডোজ টিকা সংগ্রহ করার জন্য কয়েক বছরও লেগে যেতে পারে। আর গুজব ও অপপ্রচার ছড়ানো মহলের মানুষগুলোও গোপনে কিংবা প্রকাশ্যে টিকা নিয়ে নিজেদের ধন্য ভাববেন। ২৭ জানুয়ারি ২০২১ বাংলাদেশের কুর্মিটোলা হাসপাতালের সেবিকা রুনু ভেরোনিকা কস্তাকে কোভিশিল্ড ভ্যাকসিন প্রদানের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করা হয়েছিল করোনাভাইরাস টিকাদান কর্মসূচি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা টিকাদান কর্মসূচি উদ্বোধন করে যথার্থই বলেছেন, ‘আমাদের দুর্ভাগ্য হলো কিছু কিছু লোক থাকে যারা সবকিছুতেই নেতিবাচক ধারণা পোষণ করেন। কোনো ভালো কাজ করতে গেলে সেখানে বিরূপ সমালোচনা, মানুষের মধ্যে সন্দেহ ঢোকানো, মানুষকে ভয়ভীতি দেওয়া, এ ধরনের কিছু কাজের কারো কারো অভ্যাস আছে। আমি চাই, তারাও সাহস করে আসবেন। আমরা তাদেরকেও ভ্যাকসিন দেব, যাতে তারাও সুরক্ষিত থাকেন। তাদের কিছু হলে আমাদের সমালোচনা করবে কে?’অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার যে ভ্যাকসিন ব্রিটেন, ইউরোপসহ উন্নত দেশগুলো ব্যবহার করছে, সেই ভ্যাকসিনই ভারতে উৎপাদন করছে সিরাম ইনস্টিটিউট। দুটির মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। ভারতে উৎপাদন হচ্ছে বলে বাংলাদেশ সহজে এই ভ্যাকসিন পাচ্ছে। অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিনের ট্রায়াল হয়েছে ব্রিটেন, ব্রাজিল, দক্ষিণ আফ্রিকা এবং সীমিত পরিসরে ভারতে। এর বাইরে ভারতের প্রতিষ্ঠান ভারত বায়োটেক ‘কোভ্যাকসিন’ নামে একটি ভ্যাকসিন উদ্ভাবন করেছে। যার ট্রায়াল হয়েছে ভারতে। বাংলাদেশ কোভ্যাকসিন উপহার পায়নি, কেনেনি বা কেনার আলোচনাও হয়নি। বাংলাদেশ উপহার পেয়েছে, কিনেছে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিন। প্রথম ধাপে ৭০ লাখ ডোজ কোভিশিল্ড মজুদ করা হয়েছে বাংলাদেশে। ৭ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশে টিকা প্রদান কর্মসূচি সবার জন্য উন্মুক্ত করা হয়, ২০ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ১৪ দিনে টিকা নিয়েছেন ২০ লাখ ৮২ হাজার ৮৭৭ জন। বাংলাদেশে করোনার টিকা নিতে নিবন্ধন করতে হবে ‘সুরক্ষা’ নামক ওয়েব পোর্টালে (িি.িংঁৎড়শশযধ.মড়া.নফ)। করোনার টিকাদান কার্যক্রম শুরুর পর বিশ্বের হাতেগোনা কয়েকটি দেশ তাদের এক শতাংশ মানুষকে টিকার আওতায় আনতে পেরেছে। সেই তালিকায় বাংলাদেশও স্থান করে নিয়েছে। বাংলাদেশের আগে টিকা কার্যক্রম শুরু করে জনসংখ্যা বেশি থাকায় ভারতও ওই টার্গেটে যেতে পারেনি।

করোনাভাইরাস মহামারি বর্তমান বৈজ্ঞানিক উৎকর্ষতার অতি আধুনিক সময়ে মানুষের কল্পনারও অতীত এক ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। ২০২০ সালের ৮ মার্চ বাংলাদেশে প্রথম করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়, প্রথম মৃত্যুর ঘটনা ঘটে ১৮ মার্চ। ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২১ পর্যন্ত বাংলাদেশে আক্রান্ত হয়েছে ৫ লাখ ৪৩ হাজার ২৪ জন, মৃত্যু হয়েছে ৮ হাজার ৩৪২ জন, সুস্থ হয়েছে ৪ লাখ ৯০ হাজার ৮৯২জন। সারা বিশে^ আক্রান্ত হয়েছে ১১ কোটি ১৪ লাখ ২৪ হাজার ৬০৮ জন, মৃত্যু হয়েছে ২৪ লাখ ৬৭ হাজার ২১২ জন, সুস্থ হয়েছে ৮ কোটি ৬২ লাখ ৯৯ হাজার ৬৩৮জন। এই ভাইরাস থেকে মুক্তির সুনির্দিষ্ট ওষুধ নেই, ভ্যাকসিন ছাড়া। বিস্ময়করভাবে চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা এই প্রথম এত কম সময়ের মধ্যে ভ্যাকসিন উদ্ভাবন করেছেন। ট্রায়ালে কার্যকারিতা প্রমাণের পর মানুষের শরীরে ভ্যাকসিন দেওয়াও শুরু হয়েছে। গত ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২১ পর্যন্ত বিশ্বের ৮৬ দেশে প্রায় ২০ কোটি ডোজ করোনা ভ্যাকসিন দেওয়া হয়েছে। এএফপির খবরে বলা হয়েছে, এই পরিসংখ্যান অনুসারে, এই ২০ কোটি ডোজের ৪৫ শতাংশই পেয়েছেন বিশ্বের ধনী ৭ দেশের জোট জি-৭-এর নাগরিকরা। কোনো দেশ থেকেই টিকা নেওয়ার কারণে কোনো মানুষের খুব বড় ধরনের কোনো পাশর্^প্রতিক্রিয়ার খবর পাওয়া যায়নি। বাংলাদেশেও এখন পর্যন্ত পাশর্^প্রতিক্রিয়ার তেমন বড় কোনো ঘটনা শোনা যায়নি কিংবা কেহ মারাও যাননি।যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংবাদমাধ্যম ব্লুমবার্গ র‌্যাংকিংয়ে মহামারি মোকাবিলায় বাংলাদেশের অবস্থান ২০তম, অন্যান্য দেশের সঙ্গে তুলনায় বাংলাদেশ বেশ ভালো অবস্থানে আছে। সরকারের সর্বশেষ সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, পর্যায়ক্রমে দেশের মোট জনসংখ্যার ৮০ শতাংশ অর্থাৎ ১৩ কোটি ৮২ লাখ ৪৭ হাজার ৫০৮ জনকে বিনামূল্যে করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) টিকা দেওয়া হবে। পৃথিবীর ৭৭০ কোটি মানুষকে প্রতিরোধী টিকা দেওয়া বিশাল একটা চ্যালেঞ্জ। এত বড় চ্যালেঞ্জ অতীতে কখনো আসেনি। টিকা দেওয়া থাকলে মানুষ সংক্রমিত হবে না, মহামারির অবসান হবে। মহামারি অবসানের উদ্দেশ্যেই এই টিকা দেওয়া। সারা পৃথিবীতে ভ্যাকসিন নেওয়া একটি অপরিহার্য বিষয়ে পরিণত হবে। ভ্যাকসিন নেওয়া আর না নেওয়া, মানুষ চিহ্নিত হবে দুই দলে। ভ্যাকসিন নেওয়াওয়ালারা উড়োজাহাজ, ট্রেন, লঞ্চ এমনকি গণপরিবহনে, অফিশিয়াল কার্যক্রমে অগ্রাধিকার পাবেন। নিজের জীবন, পরিবার, প্রতিবেশী, সমাজ তথা দেশের সবার জীবনকে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য টিকা নিতে হবে। আমরা ভাগ্যবান এ কারণে, আমাদের দেশের সরকার কোভিড-১৯ মহামারির হাত থেকে রক্ষায় বৈশি^ক তীব্র প্রতিযোগিতার মধ্য থেকেও সময়মতো টিকা সংগ্রহ করেছে এবং দেশীয় নানা ধরনের বাধা কাটিয়ে সফলভাবে বিনামূল্যে টিকা প্রদান কর্মসূচি অব্যাহতভাবে চলমান রেখেছে।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট, ganash74@hotmail.com