অনলাইন ডেস্ক : প্রতি ১০০ মিটার জাল ফেলে ঘণ্টায় ৫০টির বেশি ইলিশ ধরা পড়লে এবং পানির গুণগত মান ভালো হলে ওই নদী ইলিশের অভয়াশ্রম হিসেবে বিবেচিত হয়। বরিশাল, শরীয়তপুর ও চাঁদপুর জেলার সীমানা-সংলগ্ন মেঘনায় এসব গুণ থাকায় সংশ্নিষ্ট ৮২ বর্গকিলোমিটার নদী ইলিশের অভয়াশ্রম ঘোষণার সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়েছে। যে কোনো সময় দেশের ষষ্ঠ ইলিশ অভয়াশ্রমের গেজেট প্রকাশ করবে মৎস্য অধিদপ্তর। তার আগেই অভয়াশ্রমের অস্তিত্ব হুমকির মুখে ফেলেছে পরমাণু শক্তি কমিশনের একটি সিদ্ধান্ত। তারা প্রস্তাবিত অভয়াশ্রমের মধ্যে হিজলা উপজেলার হিজলা-গৌরবদী ইউনিয়নের চরমেঘায় দেশের দ্বিতীয় পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের প্রাথমিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে। শক্তি কমিশনের উচ্চপর্যায়ের বিশেষজ্ঞ দল গত শনিবার চরমেঘা পরিদর্শন করে ওই সিদ্ধান্ত নেয়, যা বাস্তবায়ন হলে মেঘনায় ইলিশের খনি তছনছ হয়ে দেশের ইলিশ সম্পদ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা করছেন মৎস্য বিশেষজ্ঞরা।
এ বিষয়ে মৎস্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. গুলজার হোসেন সমকালকে বলেন, হিজলা-সংলগ্ন মেঘনার ৮২ বর্গকিলোমিটার অভয়াশ্রম ঘোষণার সব প্রস্তুতি শেষ। এখন সেখানে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র হলে অভয়াশ্রম ঘোষণা শুধু বিফলে যাবে না, মেঘনার প্রাণিজসম্পদও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তিনি বলেন, ইলিশের জন্য সংরক্ষিত এলাকায় বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা যাবে কি-না এবং স্থাপিত হলে নদী, মৎস্য সম্পদ ও জীববৈচিত্র্যের কী ধরনের ক্ষতি হতে পারে- এসব বিষয় নিয়ে পারমাণবিক শক্তি কমিশনকে অবশ্যই মৎস্য অধিদপ্তরের মতামত নিতে হবে। তবে এখন পর্যন্ত তারা মতামত চায়নি।
চাঁদপুর ইলিশ গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. আনিছুর রহমান বলেন, আমি উদ্বিগ্ন। মেঘনার সংরক্ষিত এলাকায় বিদ্যুৎকেন্দ্র হলে শুধু ইলিশ নয়, পুরো মৎস্য সম্পদই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মো. খোরশেদ আলম বলেন, ২০১১ সালে সুনামির সময় জাপানের প্রধান পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র এলাকায় ছিলাম। সুনামিতে ওই বিদ্যুৎকেন্দ্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে বর্জ্য পানিতে মিশে যায়। ফলে প্রাণি ও জলজসম্পদ দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। হিজলার প্রসঙ্গে বলেন, কোনো কারণে জ্বালানির বর্জ্য পানিতে মিশে গেলে শুধু মৎস্যসম্পদ নয়, আশপাশের ফসলও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তা ছাড়া বিদেশিরা এসব স্থাপনা নির্মাণ করলেও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য দেশে প্রয়োজনীয়সংখ্যক বিশেষজ্ঞও নেই।
শনিবার চরমেঘা পরিদর্শনকারী দলের নেতৃত্বে ছিলেন দক্ষিণাঞ্চল নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্ট নির্মাণের সম্ভাব্য স্থান নির্বাচন দলের প্রধান ও বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. এএফএম মিজানুর রহমান। ইলিশের অভয়াশ্রমে বিদ্যুৎকেন্দ্র হলে এর ক্ষতিকর দিকগুলোর ব্যাপারে তিনি বলেন, স্থান নির্বাচন চূড়ান্ত করার আগে সেখানকার ভালোমন্দ দিকগুলো বিবেচনায় রাখা হবে।
ড. মিজানুর জানান, প্রকল্পের অধীনে ২০১৯ সালের মধ্যে দক্ষিণাঞ্চলে ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্নম্ন একটি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের কাজ শুরু হবে। তারা বরিশালের হিজলা ও বরগুনার কয়েকটি স্থান পরিদর্শন করেছেন। তার মধ্যে হিজলার চরমেঘা উপযুক্ত জায়গা বলে মনে হচ্ছে। সেখানে স্থাপিত হলে প্লান্ট থাকবে নদী থেকে দুই কিলোমিটার দূরে। শুধু কুলিংয়ের জন্য নদীর পানি ব্যবহার করবেন।
প্রস্তাবিত ষষ্ঠ অভয়াশ্রমের সমন্বয়কারী জাহিদ হাবিব সমকালকে জানান, দেশের চলমান ৫টি অভয়াশ্রমের চেয়ে প্রস্তাবিত ষষ্ঠ অভয়াশ্রমে ইলিশের বিচরণ অনেক বেশি। ২০০৯ সালে তারা বরিশাল-সংলগ্ন মেঘনায় পর্যবেক্ষণ শুরু করে ২০১১ সালে ইলিশের বিশাল বিচরণ ক্ষেত্রের খোঁজ পান। ২০১৩ সালে এটি অভয়াশ্রম ঘোষণা করার প্রস্তাব উঠলে গবেষণা ও নানা যাচাই-বাছাই শেষে এখন গেজেট প্রকাশের অপেক্ষায় রয়েছে।
বরিশালের মৎস্য কর্মকর্তা (ইলিশ) বিমল চন্দ্র দাস বলেন, প্রস্তাবিত অভয়াশ্রম তিনভাগে বিভক্ত, যার সীমানা হলো বরিশালের চরমোনাইর হবিনগর পয়েন্ট থেকে মেহেন্দিগঞ্জের বামনীরচর পর্যন্ত ১৩ দশমিক ৭ বর্গকিলোমিটার। বামনীরচর থেকে হিজলার লঞ্চঘাট পর্যন্ত ৮ দশমিক ৮১ বর্গকিলোমিটার এবং হিজলার লঞ্চঘাট থেকে মেহেন্দিগঞ্জের জাঙ্গালিয়া পর্যন্ত ৫৯ দশমিক ৪৯ বর্গকিলোমিটার। ৫৯ দশমিক ৪৯ বর্গকিলোমিটারের মধ্যেই মেঘনার বিষকাঠির চরপয়েন্ট থেকে চরমেঘার অবস্থান। এসব এলাকা হলো ইলিশের খনি।
হিজলা-গৌরবদী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মিলন বলেন, হিজলা, ভোলা ও চাঁদপুর থেকে প্রবাহিত মেঘনার মিলনস্থল হলো চরমেঘার মোহনা। চরমেঘার তিন পাশ দিয়ে মেঘনা বয়ে গেছে। সারাবছরই সেখানে প্রচুর ইলিশ ধরা পড়ে।
বরিশালের জেলা প্রশাসক মো. হাবিবুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, পরমাণু শক্তি কমিশনের পরিদর্শনকারী দল হিজলার চরমেঘা পছন্দ করেছে। এজন্য ইলিশের অভয়াশ্রম ক্ষতিগ্রস্ত হলে প্রয়োজনে নদী থেকে ৩ কিলোমিটার দূরে বিদ্যুৎ প্লান্ট স্থাপন করা হবে।